রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২২

বিরতির পর ; সংখ্যা ১৭|| বর্ষ ৩|| পর্ব ১

 



যাঁরা লিখলেন:-  একটি কবিতা: শৌভিক রায়, রুপক সান্যাল, শুভ্রদীপ রায়, পঙ্কজ ঘোষ, উজ্জ্বল বর্মন, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, মধুমিতা বসু সরকার, ঋষিতা চক্রবর্তী, সৌমাল্য গরাই

একাধিক কবিতা: সন্দীপন দত্ত,  রাজা, সৌরভ মজুমদার, অনুশ্রী যশ, তিতীর্ষা জোয়ারদার, স্বাগতা, চন্দ্রাণী গোস্বামী , নিশীথ বর্মন, শমীক জয় সেনগুপ্ত, সৌরভী রায়, নীলাদ্রি দেব

গল্প: অগ্রদীপ দত্ত

প্রবন্ধ: পুরুষোত্তম সিংহ



Web ডুয়ার্স

নতুন আস্তানা -  রামকৃষ্ণ রোড, আশ্রমপাড়া, হাকিমপাড়া, শিলিগুড়ি,৭৩৪০০১

পাহাড়ি আস্তানা - কুর্তিপাড়া, চালসা, জলপাইগুড়ি, ৭৩৫২০৬ 

যোগাযোগ- ৯৭৩২১৬৬৩৩২

ইমেইল - webdooarss@gmail.com


প্রচ্ছদ ডিজাইন - সন্দীপন দত্ত

প্রকাশক - web ডুয়ার্স 

সজ্জা ও বিন্যাস - অনিমেষ সরকার

সহ সম্পাদক - উজ্জ্বল বর্মন, মৌমিতা দাস

সম্পাদক - অনিমেষ সরকার 

ফেসবুক আইডি - Web Dooarss



সম্পাদকীয়

ফেরার কথা ছিল। আর ফিরব বলেই এই তালগোল পাকিয়ে যাওয়া সময়ে ফিরে এলাম। যতবার মনে হয়েছে আমাদের ফেরা উচিৎ  ততবার আমরা ফিরেছি। অতীতে কী কাজ করেছি আমরা সেইসব ধুলো ঝেরে  আপাতত পরিশ্রুত হয়ে বসলাম। আসুন কন্টকশয্যায়  বসা যাক।  প্রচুর প্রচুর উপদেশ পেয়েছি ওয়েব ডুয়ার্স ঠিক কাদের মতো করে চেষ্টা করা দরকার, কাদের মতো করে কাজ করা উচিৎ। এইসব উপদেশ মাথা পেতে নিয়ে   নতুন করে ভাবা যাক। আমরা ঠিক কীভাবে কাজ করব তা আমরা এবং আমাদের শুভানুধ্যায়ীরা মিলে ঠিক করে নেব। এই অন্ধকার সময়ে চলুন আলো জ্বালানোর সামান্য চেষ্টাটুকু করা যাক। আমাদের প্রচেষ্টা কথা বলুক আমাদের মুখের চেয়ে বেশি। সঠিক সময়ে সঠিক রিঅ্যাকশন দেওয়া যাক। দীপাবলির রাতে শোষণতন্ত্রের অবসান হোক। মানুষ গর্জে ওঠার সাহস পাক বঞ্চনা আর রক্তচোষা মুখের লম্বা জিহ্বা থেকে। আর কলম হোক হাতিয়ার সময়কে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করতে। শিল্পের যেকোনো মাধ্যমই হোক যাবতীয় স্বর। এই ফাঁকে আসুন এই সময়ে কী লেখা হচ্ছে পড়া যাক, আপনারা পড়ুন আর নিজেদের কাছে সঞ্চয় করুন। পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা হবে আবার...



একটি কবিতা//–


রাত পার হয়ে

শৌভিক রায়


মুখ আর মুখোশের দূরত্ব 

বুঝতে না বুঝতে,

কখন যেন রাত পার হয়ে 

নতুন আলো,

খেলা করে খোলা চোখে


লিখে যায় বালক

যোদ্ধা পিতার কথা

নিজস্ব অক্ষরে…



জন্ম 

রূপক সান্যাল 


সব শেষের সাথেই আরম্ভের দেখা হবে একদিন  

কী কথা হবে ওদের সাথে? 

সব মৃত্যুর ঘরেই একটা জন্ম অতিথি হয়ে আসবে,  

ধ্বংস এসে হাত ধরবে গড়ে ওঠার, ওকে 

                        বড় হওয়া শেখাবে বলে  


আমার এখন ঘাসকে ডিঙিয়ে 

ঘোড়ার কাছে পৌছে যাওয়া উচিত,  

আর তুমি কিনা আকাঙ্খাকে লেলিয়ে দিচ্ছ স্বপ্নের পেছনে? ... ছিঃ!  


সব বাসনার সাথেই একদিন বৈরাগ্যের দেখা হয়ে যায় 

যারা পথ হারিয়েছে তারাও একদিন পথ খুঁজে পাবে ঠিক 


শুধু তোমার সাথেই আর কোনও দিন দেখা হবে না আমার



ঈর্ষা

পঙ্কজ ঘোষ


অন্ধকার আর রাতের ভেতর

যে ছায়ার পার্থক্য আছে

তার থেকে পালিয়ে বেরোনোকে আমি ঘৃণা করি

ভাবি সচেতন প‍রাজয়


তুমি অন্ধকারের ভেতর তীব্র আলো

তুমি রাতের ভেতরে বসে থাকা

আগুন আগুন ভোর

আমি শুধু শিকারি বাঘের মতো

চার পা পিছিয়ে যাই বারবার


কেমন যেন তোমার ভালোকে আমি ভীষণ ভয় করি।।।




দেবী/প্রেয়সী

শুভ্রদীপ রায়


এভাবেই বলো। আধো আধো। এক রবিবাসরীয় সকালটা লেখা থাকুক আমাদের নামে। যেভাবে নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ দেখা দেয় ঢেউ,সেভাবেই তুমি আসো। আমার ভাঙাচোরা শরীরে একটা মায়াবী হাত বুলিয়ে দাও।সমস্ত ফাটল জুড়ে ফুটে উঠুক অসংখ্য তারা।আমার কালো শরীর আর স্টারি নাইটস মিলে মিশে একাকার হয়ে যাক। আমি যেন এক বোবা ক্যানভাস, যে সমস্ত স্ট্রোকে রঙ মাখাও  সেভাবেই কবিতা লিখতে চাইছি।


লিখতে চাইছি তোমার আর প্রিয় নায়িকার সামঞ্জস্য নিয়ে। লিখতে চাইছি তোমার সেবাপরায়নতা নিয়ে। ইথার তরঙ্গে তুমি যে নিকোনো উঠানের ছবি দিচ্ছ আমি তাকে নিয়ে লিখতে চাইছি একটি কবিতা। এভাবে আসলে হয় না। আবার এভাবেই হয়ত আসার কথা ছিল। 


তোমার সমস্ত উল্কি দেখে ফেলছে কেউ কেউ।আমি তো চাইলেও দেখতে পারছি না। কিছু একটা ঢেকে দিচ্ছে আমার শঠ দৃষ্টি।লোকে বলে আমার ধর্ম কর্মে মতি আছে।আমার হাতের প্রতিটি রেখায় নাকি বৈরাগ্যের স্পষ্ট আভাস । তাই হয়ত এই বয়সেই জিভে কেমন একটা ত্যাগের স্বাদ পাই। তোমাকে বলি না সেসব। তোমার স্বাধীনতা কে একবার উপভোগ করতে চাইছি আমার সমস্ত সংশয় বিভ্রান্তি সরিয়ে রেখে। জীবন আমার কাছে একটা বিভ্রান্তি সম, একবার  শরীরে অনুরাগ ঢেলে দাও দেবী। ঢেকে দাও এই ভাঙাচোরা শরীরের অজস্র মেকি ক্ষত।


মাঝে মাঝে তোমাকে সাদা প্রস্তর প্রতিমা মনে হয়। মনে হয় যেন একটা গভীর নীল পুকুর, শান্তির পাশাপাশি একটা রহস্য। যে স্নেহ আর বিশ্বাস  নিজের কাজে ছড়িয়ে দিচ্ছ তার পাশে নিজেকে বেমানান লাগে মাঝে মাঝে। তাই হয়ত গুটিয়ে রাখি কিছুটা। শুধু শুনি, হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে তোমার বাণী ভেসে আসে। আমি আজ থেকে তোমার সাধক হিসেবে নিজেকে সকলের থেকে আলাদা করে ফেললাম।


যে শব্দটি তুমি বুকে ধারণ করে আছো তার প্রতি আমার অদম্য আকর্ষণ। একটি শব্দ-- অজস্র অভিঘাতে আমাকে  অভিধানমুখী করে ফেলছে। আমি তার জানা অজানা বিভিন্ন ব্যবহারে চমৎকৃত হচ্ছি। অথচ তুমি সে সব বেমালুম অবজ্ঞা করছ। রাত বাড়ছে আর আমি কেমন একটা বিবশ হয়ে যাচ্ছি। তোমার ফোলা ফোলা ঠোঁটের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছে।এই বুঝি সাধনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে আমি প্রেমে পরে যাব বরাবরের মত। রূপোলী কর্ণকুন্ডলে কিছু একটা জাদু মেশানো আছে। চাইলেও ফিরতে পারছি না সেই কুহকের থেকে। এবার ফেরাও,নিজেকে ঢেকে নাও কিছু একটার চাদরে।নিজের এতটা লাল মেলে দিও না  এই শুষ্ক কবির কাছে। আমি নিজস্ব খরাকাল নিয়ে বসে আছি দীর্ঘ সময়। তুমি নিজের তন্বী তরলতা নিয়ে এতটা কাছে এসো না আর।


হে দেবী, একটা অনন্য উপহার দাও। আমার এই কবিত্ব কেড়ে নিয়ে ঘোরতর সংসার দিয়ে যাও আমার হিসেবের খাতায়। যে বন্ধুকে আমি অত্যাগসহন কৃষ্ণসখার মত ভালোবেসেছিলাম সেও আজকাল একটা দোমড়ানো মোচড়ানো ব্যাগ হাতে নিয়ে ছুটোছুটি করে এ বাজার থেকে সে বাজার। এসব আমি দেখতে চাইনি। ঝলসে যায় চোখ। তরুন সন্ন্যাসী বলছেন, ক্রান্তদর্শীদের এই নাকি আশীর্বাদ ও অভিসম্পাত। কেড়ে নাও আমার এযাবৎ প্রাপ্ত সমস্ত খ্যাতি ও থরে থরে সাজানো পুরস্কার। হে দেবী, একটা সংসারী মন ও মনন লিখে দাও আমার খাতে।




জোকার

মধুমিতা বসু সরকার


একটি অবয়ব মধ্যরাতে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে কিছু 

আতিপাতি তল্লাশ চালাচ্ছে --

আমার যাবতীয় দ্বিধাহীন উন্মুক্ত --

এক বিশালাকায় শীতল সাপের ছোবল অনুভব করি

রক্তে মত্ততা, ত্বকে স্পর্শানুভূতি প্রবল ও ধাবমান --

প্রচন্ড শীৎকার নাভিমূল থেকে শুরু পায়ের পাতা অবধি দীর্ঘায়ত,

ওমের বিন্দুবিসর্গ ও ছিলোনা তাতে  অথচ

আমি হেলে যাই ঘন বর্ষনের দিকে --

বৃষ্টি পড়ে,, বিন্দু বিন্দু ঘাম কপোল জুড়ে --

আমি চলৎশক্তিহীন, সাড়হীন উরু,

কখন যেন অনুভব করি অবয়বটি সরীসৃপের, মানুষের নয় --

ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে স্বপ্নে দেখি

আমি একটি  আহত সড়ক, আমার ওপর দিয়ে যে যান চলে গেছে, একটি গভীরতম ক্ষত ---

প্রশ্ন করি তুমি কি রেখে গেলে?  

বিশ্বাস? 

আমি কি রেখে যাচ্ছি দ্যাখো একবার!  

আমার হৃদয় --

তুমি যাকে নিয়ে সার্কাসে খেলা দেখাতে পারো -

অবলীলায় ----


যা লেখা নেই

সৌমাল্য গরাই


কত আশ্চর্য পংক্তি লেগে থাকে, 

                                       বিকালের রোদে

পাখিদল খুঁটে খায় দানা ভেবে

একে একে জড়ো হয় পিঁপড়েরাও

সেরে নেয় প্রকৃত আহার


প্রতিটি লেখায় থাকে অশ্রুপালনের রীতি 

তবুও বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় চিহ্নিত  সাদা পাতা নিয়ে

অচিন পাঠক খালি উৎকর্ষের কথা ভাবে

একথা প্রকৃত সত্য নয়,

অন্তিম পৃষ্ঠার পর কবি ও  সমস্ত অক্ষরেরা

স্বপ্ন ও নশ্বর সমাধির  দিকে চলে যায়


কতক কথা

উজ্জ্বল বর্মন


এখন কবিতা আর আসেনা, যা আসে বা যা দেখি মায়ের চোখে জ্বলন্ত আগুন;

দেখি চোখে লুকিয়ে রাখা ভয়ংকর মেঘ।

বাবার চোখে কখনো মেঘ দেখিনি হয়তো সন্তর্পণে বদ্ধ করে রেখেছে,

প্রচন্ড মেজাজ দেখেছি, অজান্তে বট পাকুড়ি হয়ে ছায়া দিতে দেখেছি,

রক্ত ঝরা দেখেছি সমস্ত শরীর বেয়ে মিশে যাচ্ছে মাটিতে।

এমনি অনেক কবিতা দেখছি রোজ এই শহরে।

যারা স্ব-ইচ্ছায় ইতিহাস হতে আসেনি, তারাও ক্রমশ ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছাপ ফেলে চলেছে।


কলমটিকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে শব্দ বুনছি,

পেটে খোরাক নেই অথচ সংগ্রাম চলছে মৃত‍্যুর।

লিখে চলেছে সুখের রহস‍্যময় সন্ধান!

কলমটি অথচ কত নির্বোধ! সে জানেই না-

অসুখ তাড়া করলে আর সুখে থাকা যায়না।


কাঁচ 

শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়


মসৃণ, ধারালো 

মুখ দেখা বা খুন করা 

এপিঠ আর ওপিঠে 


আমরা ভয় পাই 

পিছনে ওদের মুখ দেখে

আর ওরা ভয় পায় 

খুন হওয়ার ভয়ে।  


গন্ধ আসে।

আঁতরের গন্ধ পায় ওরা, 

আমরা পাই

শুকনো গোলাপের পাঁপড়ির গন্ধ, 

কাদের যেন ডায়েরির ভাঁজে রাখা। 


শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ আর 

শুকিয়ে যাওয়া রক্ত 

দুটোর রং এক, 

কোথাও গিয়ে ওরা মিশে যায়

ভাবতে বসি দিগন্তরেখার কথা,

হঠাৎ বৃষ্টি নামে, 

আমরা বুঝতে পারি 

বৃষ্টি জমে কাঁচ তৈরি হতে পারে। 



ভাড়াটে

ঋষিতা চক্রবর্তী 


ইতি টানাটা কি সম্ভব?

সেটা হয়তো নয়

এক ছাদের তলায় সাজানো সংসার

ছাদ জুড়ে আকাশ 

আরও কত কি;

একটি শিশু আছে 

ওর বাড়িটিই ভাড়া নিয়েছি

ওদের বাড়ি অনেক ভাড়াটে

উঠনে আমরা সারাদিন খেলি,

দাবা থেকে ডাঙ্গুলি সব

কখনও লুকোচুরি, কখনও কানামাছি 

শিশুটি হাসে

কখনও দল বেঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি 

কখনও আবার একার কাজ, নিজ নিজ 

শিশুটি খালি হাসে 

ও যেদিন বাড়ি ছাড়তে বলবে

হিসেব নিকেশ মিটিয়ে ছেড়ে দেব

আবারও যদি কখনও এখানে ভাড়া থাকতে আসি

বাকি ভাড়াটেরা আমায় চিনবেনা, আমিও না

আমার মনেও পড়বেনা এখানে কেমন ছিলাম,

কতনম্বর তলায়, কারা পরশি ছিল 

কেমন ছিল সম্পর্ক

ঘরটাকে আবার সাজিয়ে বাস শুরু করবো

আবার একদিন সব ভুলে,

হিসেব নিকেশ মিটিয়ে

ও যেদিন চাইবে বাড়ি ছেড়ে দেবো

আমি ওর চিরকালের চেনা।





একাধিক কবিতা//–


সন্দীপন দত্ত-এর গুচ্ছ কবিতা

পূজা ২২


এবার যাব না কাশফুল সমাচারে। পূজা অবশ্যম্ভাবী হয়ে এসে যাবে। ঘর থেকে রঙিন কাচের ফল বের হবে কিছু। এবার যাব না তবু যাতায়াত হবে। 


হাওয়ার দিকে মুখ করে বসে থাকব৷ আনন্দ একটি নিকেতন হবে৷ জলের কাব্য নিয়ে ভিজে যাবে আঙুলের ফল৷ গাছ থেকে গাছে ইতর সন্ন্যাসীদের আক্ষেপ সংসার সরে যাবে।


এবার যাব না মেঘগাড়ি মোড়ে। কথা নিয়ে ফ্যালনা আবেগ নিয়ে মাখো মাখো চুল নিয়ে যাব না এবার কোনও সেবাআশ্রমে৷ অনাথ শরীর তবু ঘাস হবে। ঘাসের অবলীলা কাদা হয়ে রয়ে যাবে। যাব না তা বলে কি কেউই যাবে না?


এ হয় না। হয়নি এসব কক্ষনও, কুক্ষণে। লাজবাব শিরদাঁড়া সহ্য সহ্য হয়ে যাবে৷ এবার সব রোগ মোচনের তরে তুলে রাখা রাগ হয়ে যাবে৷ দূরত্বে ঋতুকাল রেখে দেবে বয়সের দানা।


এবার আলতো কাপড়ে ঈষৎ ঊরু হবে৷ হবে না চোখ তবু চোখাচোখি হবে৷ কথা হবে। কথা রাখা কি হবে? কী হবে? আহা এবার যাব না ঘন হতাশ ফুল সমাগমে৷ 


অল্প দুঃখ হবে। বিলাস প্রচুর মনে হবে। দুয়েকটা দর্শন কাব্য হতে নেবে। সবটাই ফাঁকা ঈশ্বর হয়ে যাবে। জোর হাত ঠাকুর তুমিই তো জ্ঞান। অহং তুমি। এবার যে যাব না ঊরু ছোঁয়া নদী বিচরণে। তুমি হবে তো বলো? আমিও কি ফের নমো হব?



ক্যালেন্ডার ফ্যালেন্ডার


আরে হেই সতেরো বিকেল৷ ওহে একুশ সন্ধ্যা। আহা কুড়ি গোধূলি। বাইশ দুপুর। সব মনে রেখে দিলে মন কোথা রাখা হয়? 


বিষণ্ণ হই। বিষ? কই না তো! 


আলগোছে ঘরকন্না থেকে আ-কার তুলে নিয়ে কে কোথায় টি-শার্টে টিপ পরে বসে আছে ফরসা সকালে। 


এই যে কেমন নরম লেখা, ছোঁয়া যায়, ডেবে যায়; ঢোকা যায় না। এই তো আমার প্রতিবাদ, রাষ্ট্র, ভাষা, জীববিজ্ঞান! 


যত্রতত্র খুঁজে পাওয়া ফ্যালিক সিম্বল, নিজেকে নোংরা লাগে, মনে হয় সৃষ্টি আমার মেয়ের নাম।


সব মনে থেকে যায়, আর থাকে না কোনও কিছুই। ইতিহাস বই খুলে মাপি প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষের আঙুল। স্বর্গ থেকে ভেসে আসে একটি সুখশব্দ। দেখি জ্যোতি নিয়ে ভেসে যাচ্ছে দিব্য বালিকারা। আমার এখানে একটি নৌকোর দোকান আছে।


ঝিনঝিন শব্দ পড়ে। আলগা হই৷ পেছন থেকে টেনে ধরি জামা। চুল খুঁজি৷ কাঁধ খুঁজি। কিন্তু সে দাঁত কোথা গেল! হেই হেহ আঠারো পুরুষ। আঠারও কিছু স্পেস লাগে। শক্ত হও। হাতে তুলে নাও। আর কিছু না হোক সৃষ্টিই হবে।



লেখো


টুকটুক করে লেখো। দ্রাবিড় সভ্যতায় এই তো টেকা। আর যখন কিছুই পারো না— লেখো। অন্তত পারছি মনে হয়; পারো না জানি। তবু চুপচুপ করে লেখো। 


বেহদ্দ বকওয়াস লিখে লিখে লিখতে লিখতে একদিন কোনও একবার 


বেড়াল বেরিয়ে আসবে, ঝুলি হয়ে যাবে আশ্চর্য লাল ম্যাটাডোরের সাধনসঙ্গী; বেড়ালটি খরগোশও হবে, রুমাল হবে টুপি।


টুপির সহিত করোটি উড়াইয়া দিব...


ভাইসব একদিন তো দ্রাবিড়ও ছেড়ে আসে ক্রিজ, সেইসব ছক্কায় হাততালি পড়ে না।


 সু


তুমি যেমন প্রকাশ্যে আমায় গালি দিতে পারোনি, আমিও তোমায় দূর থেকে মনে মনে 'শুভ বিজয়া' বলেছি।


শুভ একটা বোধ, একটা ইচ্ছা, এছাড়া সবই তো লবণের অভাব।


শব্দ কম পড়লে মনে হয় পড়ে যাচ্ছি অবাকের পৃথিবী থেকে সাদা থান কাপড়ের মেঝেয়, খুব একটা লাগবে না, শুধু ব্যাপারটা এত অ্যাবসার্ড, এখানে শব্দটার মতো, যে নিজেকে নিয়ে কী করতে হয় হারিয়ে ফেলি। 


তুমি এসবের পর আমায় পাগল বলবে, শুরুতে স্নেহ, তারপর বিষ, একটি শব্দ একাধিক শর হয়ে আসতেই পারে, আমি শুধু এটুকুই চাই যে তুমি বলো।


শুভ এক ছোটকালের বন্ধু, ওর একবার মন খারাপ হয়, তারপর বন্ধুতা নিয়ে চলে যায় ঝিকাগাছের পৃথিবী ছেড়ে, আমি শুভকে খুঁজি, ভাবি শুভ একটা বোধ, একটা ইচ্ছা।


ভুল?


নিশীথ- এর দুটি কবিতা


বিশুদ্ধ ভাবনা


১. 

রাস্তা পেরোলে তোমার বাড়ি।

চোখ বুজলে দিবাস্বপ্ন।


২. 

গাড়ি যায় ঘোড়া যায়।

আমার যাওয়ার হলে কবেই চেপে যেতাম।


৩.

লক্ষ লক্ষ চোখ, তাকিয়ে জিগায়।

আমার লক্ষ্য কষ্ট দিতে চায়নি?


৪. 

ভীষণ ফাঁকা মাঠ।

এত ফাঁকা তো আমার আওয়াজ ও না।


৫. 

কাকে কি শেখাই আমি!

নিখুঁত সাজার ভান করেই তোমায় ডেকেছি।


৬.

শীত ভেঙে চিৎ

তুমি জড়িয়ে ধরলে সন্তাপ কমে।


ভালো কথা


ভালো কথার শেষ নেই।

শেষ নেই জলের মতো সারল্যের।

মাছ জলে ভালো আছে

আমাদের মতো 

সমাজ বিরোধী উচ্চবাচ্য নেই।

কাল সব ভালো কথা হলেও 

সন্ধ্যা কি নামবে না?

সারাদিন ওই রোদেপোড়া মুখের

ভালো কথা ভালো লাগে?


কেন সুর করে কথা হয়না।

কথায় সুর দিলে 

কথা থাকে না।

কথা গান হয়ে গেলে

মনে ধরে কানে না।


এত সহজে ভালো কথা

বলে দিলে 

কথার 

ভালো থাকে না

না থাকে খারাপ।




সৌরভী রায়-এর দুটি কবিতা

খুঁজে বেরাই


আসমুদ্র তীরে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, 

আমি হারিয়ে যাব কিনারায়

দু একটা নৌকো বাঁধা থাকবে কথাদের ঘিরে 

দু একজন মাঝি গাইবে ঘুমের নামাবলী

পেছনে ফিরে তাকানো তখন অন্যায়

ফিরে এসে বলা যাবে না, এখনও তোমাকে চাই।

জলের স্রোত নিয়ে যাবে কোথাও 

তীরে এসে তরী ডোবাতে নেই।


একটা লাল নিশান প্রতিবার ভুল ইশারা দেবে। দেখে নেব তাদের চোখের নীল। হতভাগাদের কপালে প্রেম আঁকতে নেই। 


হাওয়ায় ভাসা পাখির মতো উড়ে

পড়বে এসে সমুদ্রেরই কাছে।

এই তো পথের পথ হয়েছে আলো 

শুধু তোমার কাছে ফেরার পথটি নেই।




ভুলতে থাকা অপেক্ষারা


বিষন্ন উৎসব ছিঁড়ে বসে বুকে

চুপচাপ বসে থাকি প্রতিবাদহীন বুকে। তারপর প্রেম নেই। আদিম সুগন্ধি মাখা ইতিহাসে মেকী হতে থাকে ভুল ঠিকানা। পুরানো সুইচড বোর্ডের রঙ বদলে যায়। লালচে রঙের প্রলেপ পড়ে অতি অনাদরে। বহুদিন স্পর্শের অভাবে ভুলে যায় একসময়ের প্রিয় অতিথিকে। নীরবে হাসি ফোটে গালে, এত জানাজানি ভুল হয়ে যায় আগামীর অজুহাতে। অজুহাত ভয়াবহ, স্বভাব অবচেতনের। 


একা পার হওয়া পর্যন্ত একটা মোড় ভালো। আরো একটা মোড়ে অপেক্ষা ক্লান্তি আনে চোখে, এই বিষন্ন চোখে...


 


অনুশ্রী যশ-এর দুটি কবিতা

এই ঘনঘোর, প্রাণনাথ


রোজ সন্ধেবেলা ঘাটের কাছে এসে বসি। অভ্যেসে অথবা ভালোবেসে। একটা নুয়ে পড়া করবী গাছ, নক্ষত্রের মতো ফুলে ফুলে একাকার। এক এক দিন তুমি আসো। নিঃশব্দে পাশে বসে মাথায় হাত রাখো। তিরতির করে কেঁপে ওঠে ঘাটের কলমিলতা। আমার বড় সাধ হয়, তোমায় কলাপাতায় ভাত বেড়ে দি, আঁজলায় তুলে আনি আস্ত সংসার। এইসব দিনে আমি নদী হয়ে যাই। এ অন্ধকার যমুনার কালো এবং তোমার বিপজ্জনক ভেসে থাকা। মন্দিরে কীর্তন সাঙ্গ হয়, 'রাধারানির জয়' বলে খোল করতালে শেষ ঝংকার ওঠে। 


ওগো, শ্রীখোল এখনই থেমো না! এই অনন্ত বিরহের আগে খানিক ডুবে থাকতে দাও।



পূর্বপুরুষ


করিম চাচা মাজার চত্বরে ঝাঁটা দেন 

পঞ্চাশ বছর ধরে - 

তাঁর আব্বা মাজার চত্বরে ঝাঁটা দিতেন

পঞ্চাশ বছর ধরে - 

এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। 

হাত শয়েক দূরে তাঁর কবর। 

ঝাঁটার থেকেও দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে করিম চাচার শরীর

তবুও প্রাণপণে মুছে ফেলতে চাইছেন

পূর্বপুরুষের পায়ের ছাপ।


 



চন্দ্রাণী গোস্বামী-এর গুচ্ছ কবিতা

শব্দ


শব্দ ঘনিয়ে আসছে...


কি বলবো! চলে যাও, কান্না পাচ্ছে

হাতটা দাও, বুকে রাখবো, পাখিটা 

দেখছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো, চুপিসারে

আকাশ ঢাকছে আমাদের...


আগাম কি বলবো তোমায়! 


তোমার ঘুম নিয়ে শুয়ে থাকব বাকি কটা দিন...!




শুভ সন্ধ্যা


টিলার পাশেই ভিড় হয়ে আসছে মেঘলা দিনের কাঠবাদাম ফুল, আর 

                                         হাসিনা মুর্মূ'র ঘোর লাগা খোঁপা


এরই মাঝে সাঁওতাল পরগনায় স্তব্ধ হয়ে থাকে আমার বহুকালের চুম্বন 

 তোমার সরল গ্রীবায়...


তোমাকে মনে পড়ে---- তোমার যৌবন বয়স


এসব তো সকলই ধান জ্যোৎস্না, আর

                      আমাদের আরণ্যক সংসার

                      সংসার থেকে সংসার ছুঁয়ে 'শুভ সন্ধ্যা'র মতো

                       অরব আরাধনা।




কেয়ার অফ ফুটপাত



ফুটপাতের যোনিজাত----

রজো জানার আগেই শলা চিনেছিল ঠিকই


শরীর বা সমীকরণ বোঝার দায় ছিল না তার

তাই ভাই বা ভাতার সবটাই জেনেছিল সম্পর্ক বহির্ভূত


আমিও তুতোজ্ঞানের মা কে চিনেছি অস্থি-মাসে

লজ্জার শরম হায়াকে বলেছি, গতরে খেটে খা


সে মেয়েটা আমায় যখন চিনেছিল

আমি তখন শরীর থেকে ঈশ্বর খুঁজে খুবলে 

ভেট দিচ্ছি সনাতনকে


আর বলেছি তাকে

কোনো এক আদিবৈষ্ণব রাতে তাকে আমি নগ্ন চুমু খাব

শরীরের আসাক্ষাতে




তিস্তা



নিরোর বেহালা শুনেই দিন কাটলো, বিকেলে নদী পাড়ে গিয়ে

       সুনীলের কবিতার মতো স্নানের আগে প্রণাম করি তাকে


এসব কথা যদি অন্ধকেও বলি, সে কি বিশ্বাস করবে!


সে তো কোনোদিন নদীকে চোখেই দেখেনি

বোঝাব কি করে নদীর পাড়ে চাঁদ, আর বেহেড মাতাল চাঁদের 

জীয়ন্ত উরুসন্ধির নিজস্ব গর্ভে নদীর ছোবল...


আমার একটা অসতর্ক শব্দের উৎসের জন্য সারারাত কান্না পেল

একটা বিষভান্ডের অলৌকিক আলোর জন্য কষ্ট হ'ল---

কাউকেই বোঝাতে চাই না

              এ আমার উন্মাদ জগতের একান্ত ভাষা।


আসলে কীর্তনখোলাই বলো আর তিস্তা-নদীই বলো

এসব দংশিত আত্মার কথা নদীই একমাত্র বোঝে


আমি লিখি বা অন্ধকার না ই লিখি

বেহালার সুরের মতো খাদে , চড়ায় গিয়ে নদী টের পাবেই


আমি কাঁদছি, ভীষণ অস্ফুটে গোঙানির মতো যন্ত্রণা হচ্ছে


আসলে নদী ছাড়া কেউ বোঝে না 

ইদানীং সারাদিন আমার মনে হয় আজকে রোমে আগুন লেগেছে।





নীলাদ্রি দেব-এর গুচ্ছ কবিতা

হলিডে


এক 


হাঁটছিলাম। দুজন হাঁটছিল। আমরা হাঁটছিলাম। দুজনকে হাঁটালাম। একজন হাঁটছিল ও দেখছিল। এই ছয়জন। একমুখে। মার্জিন পেরোতে চাইলাম। গতি যৌগিক ব্যাপার। একের পিঠে এক। আপাতত তিন বাহন। তিনটি ছোট টিম। সমস্ত মিলে একটা। মার্জিন পেরোবো। পরিকল্পনা। পৃষ্ঠায় কতগুলো দাগ। কাটলাম। বামে ও ওপরে যে রেখা, নিজেদের ছেদ করেছে বিন্দুতে এবং নাইন্টি ডিগ্রি, এপাশ ও ওপাশে সীমান্ত প্রদেশ। ভোরে রোদ নেই। কিক। কয়েকটি বিন্দু দূরত্ব মিশে একটি পথ। যা গুগল ম্যাপের সমান্তরালে। যা নির্দিষ্ট জাংশন পেরুচ্ছে। স্পোক কেটে আসছে। খাড়াই।  ডাইজেস্টিভ বিস্কিট ছিল। ফ্লাস্কে কফি। নদী কাটছিলাম প্রস্থ বরাবর। কিছু দূরত্বের পর মাইলফলক। সংখ্যাদের ব্যাক ক্যালকুলেশন। সব টায়ারের ছাপ ঐ বিন্দুতে কেন মিশছে! যে চকে দাড়ালাম, দুপাশে শান্তি পতাকা। মেঘের পেটে অন্য মেঘের জলছাপ। ফার্নগুলো নুয়ে আছে। বায়বীয় মূল। স্যাতস্যাতে দেয়ালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ধাপচাষে। মূলে মূলে যোগ গড়ে ওঠে। আমাদের ছায়াগুলো ফুট বদল করছে। দীর্ঘ সিড়ির কোনও বাইপাস নেই। বুদ্ধের ধ্যান কি এখনও স্থির? 



দুই


কোনটা ধারাবাহিক নয়! এই উঠে আসা, নামা বা না-নামার প্রবণতা। অথচ ব্র্যাকেটের বাইরে সবটার পরিমিতি থাকে। দূরে যে আলো ফুটে আছে, দূর থেকে আমাদের অবস্থানের দূর, একই গান বাঁধতে পারতে। জ্বলি, নিভি। শান্তি পতাকার নিচে যাবতীয় শর্তনিরপেক্ষ আঁতাতের প্রশ্ন। নিরাপদ দূরত্ব নিই।

ঐ যে নেমে আসব ভাবছি। গত রাত থেকে বৃষ্টি। টানা। কখনও খালি চোখে। কখনও খালি চোখে নয়। যে পথে নামছিলাম, বন্ধ। এটা নতুন গল্প নয়। পাহাড় কিছুটা গড়িয়েছে এই উঠোনে। যে পথ বিকল্প, একটা রঙিন সেতু। ঝুলছে। এরপর এঁটেল রাস্তা ছিল শুধুমাত্র টায়ারে গেঁথে যেতে। গ্রিপ হারাচ্ছি। খাদ পাশে রেখে এই যে বাঁচার চেষ্টা। এই এমারজেন্সি আলো, ঘাড়ের কাছটায়। নদীতে এসে মিলেছে এপার ওপার। অগত্যা। যখন পেরুচ্ছি, যন্ত্রের নলে জল। উষ্ণতা সব কি উবিয়ে দেয়! ওয়ানওয়ের একটি দিক বসে যাচ্ছে ধীরে। দুটো পাথরের অংশ খসে পড়ল। নির্বিকার সময় গড়িয়ে যায়। বুনো ফুলের গন্ধে যে ভ্রমর। উড়ছে। কিন্তু কোথায় এই সৌরভের চাষ!



তিন


মুখোমুখি দুটো বায়ু কাটছে। ফিরে আসা আদৌ কি ফিরে আসা! যাতায়াতে চিহ্ন। সবটা সহজ নয় এতো। সিঁড়ি, উঠে বা নেমে গেছে জেনেও ঢাল বরাবর যাবতীয় কাজ ও অকাজের নথি। ঘুম ভেঙে এলে ঘুম গাঢ় হয় আরও। নিজস্ব ছায়ার ছায়া সদ্য সবুজের নিচে আলতো। গতিবলয় ঘিরে রেখেছে মায়া। নিজেকে পেরিয়ে এত সুক্ষ্ম স্বাদ। যদিও শুরু শেষ, যদিও বাতাসের অনু, প্রতি টান। সবটা এপিঠ ওপিঠ।  আজ একটা অরণ্য ঘুমিয়ে থাকছে অন্য অরণ্যের ভেতর। পশুপাখি চোরাশিকার এসব তো ওটিটিতে দেখি। তবুও সত্যি কোনও আঙুলের ছাপ তীব্র হয় সময়অসুখে। ছাঁকনির জালে কিছু তো আটকে থাকে। আটকে থাকতে হয়।



চার


কোনও গল্প হবে না। এতটা পথ ডিঙিয়ে চুপ। চুপ বসে থাকি। উপত্যকার হাওয়া বিছিয়ে যাচ্ছে দেহ বরাবর। আমরা যারা আমরা, আদৌ হতে পেরেছি কি! তারাদের নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ছুটে আসা রাত। কোথায় শুরু ও শেষ। সবটা জীবাত্মার বীজ থেকে, গোপন সুড়ঙ্গ থেকে। প্রেম যেন। গোপন এক গলনাঙ্কের হিসেব। ঝরে পড়ছে স্থির প্রতিটি মুহূর্ত। আসলে অজস্র আঘাতের চিহ্ন জেগে উঠলে বা ঘুমিয়ে গেলে, সামান্য অস্থির হই। এসময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খানিকটা ওপরে উঠে আসতে ইচ্ছে করে। শীত আসবে অথচ শীত বুঝব না, এমন নয়। মুখোমুখি অন্ধকার আর মেঘের আলোর নিচে আপাত অপ্রস্তুত আমি বলে উঠছিলাম, কবিতা কী? গাছ থেকে খসে যাওয়া আপেল। গড়িয়ে যাওয়া। ওপর নিচ আধখাওয়া। বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল পূর্ণ হয়ে আসছে। আর এসমস্ত উত্তরের পিছনে মিছিল। আশেপাশে যে ফুলেরা, ঈশ্বরের ছায়া ওদের চোখে। আর সমস্ত রাস্তাই পেলিংএর দিকে।






শমীক জয় সেনগুপ্ত-এর সিরিজ 

নবদুর্গা


শৈলজা


পায়েতে মঙ্গলছাপ, গতজন্মের ছ্যাঁকা লাগা মন

উপলজ দেহ জুড়ে নদীদের ছোটাছুটি তাই

আবেগের কত কথা কথকের বচনে নির্ভর

উৎসের মন জুড়ে মেয়েবেলা উড়িয়েছে ছাই


পাষাণে প্রতিধ্বনি, পাষাণীর খরস্রোত মালা

সবটুকু জুড়ে থাকে আধো বোল, স্নেহ আর মায়া



ব্রহ্মচারিণী


কাঠফাটা রোদে, ঘামে 

জল এসে পুড়িয়েছে মন

বৃষ্টির ছাঁট এসে আনাচে কানাচে

রেখে গেছে ভুখা পেট, ক্লিষ্ট শ্রাবণ

রোজ রোজ খোয়া যায় গতরের পাটপাট ভাঁজ

খাবারের অছিলাটা কেড়ে নেয় সময়ের কাজ


চোখ শুধু ধরে তার তপস্যার দীর্ঘ মেয়াদ

বাদবাকি মিশে থাকে প্রতীক্ষার কালধর্ম মেনে

প্রেমসিঞ্চনে



চন্দ্রঘন্টা


গলাতে হাঁসুলি আর চাঁদ বাঁধা ঠোঁটের কোণেতে

দুহাতে আলগোছে মুছে দাও শ্রান্তিবাসর।

সেবা হয়ে ফিরে আসো, দুদণ্ড জিরোতে দাও

বুস্ট করো এনার্জি, ঋণাত্মক প্রতিরোধকে সরিয়ে


আনন্দ ছায়া দাও, 

ছত্রচ্ছায়ায় বাঁচা পাংশুল মনে।



কুষ্মাণ্ডা


সরোদ বাজছে একা শারদীয় চিলেকোঠা জুড়ে

প্রাণের উৎস তার একা থাকা প্রারব্ধলিপি

যাপনের শেষচিঠি সেও কোন বিচ্ছেদ ডাকে 

ভুলে যাওয়া মিছিলের শ্লোগানকে আনছে ফিরিয়ে 


ত্র্যহস্পর্শ জুড়ে যে আগুন আলো দিয়েছিল

অবসরকালে তার শিখাটুকু অব্যহত আছে।




কালরাত্রি


সময় বলেছে কথা, বাকি সব জলছবি জানে

কোথাও হারানো শেষে ফের ভিজে ওঠা কোনখানে

আসলে ঘুরছে চাকা, ঘুম লাগে স্বপ্ন আঁচলে

তারপর ফিরে আসা, কথা লিখি শরীরে -বাকলে


ওদের কি দোষ বলো

অনুভূতি মরেও মরে না

ওদের তো দোষ নেই


ওরা সব কালের পুতুলি।



মহাগৌরী 


ভাত বেড়েছো পাতে

সঙ্গে লবণ জল

লক্ষ্মীর ঐ হাতে

পরিতৃপ্তি সম্বল 


শান্ত হয়ে বসো

তবু ছাইচাপা এক তেজ

হালকা দিলো উঁকি

সরিয়ে ফুলসেজ


এইটুকু তো চাওয়া 

পুরো ঘর পরিবার মিলে

এক জীবনের বাঁচা

সকল শঙ্কা বিভেদ ভুলে



সিদ্ধিদাত্রী


কাজ ছিল, কাগজের নৌকো ভাসিয়ে

চেয়ে থাকি

জল মাপি

বৃষ্টির ছাঁট এসে আনাচে কানাচে খোঁজে

বাকি কাজ ভুলে যাই তাতে


সবটুকু শেষে এই ভরা সংসারে

প্রতিটি তৃপ্তির হাসি

অনির্বচনীয় শান্তি এঁকে দেয়



স্কন্ধমাতা 


খেয়েছিস!

কতদূরে আছিস?

বাড়ি ঢুকতে এত সময় কিসে লাগে?

পরীক্ষা ছিল না তোর? মুখভার কেন?


প্রশ্নেরা বাণ হয়ে ছয় মাথা বিদ্ধ করেছে


তবুও দিনশেষে ঘর বলি কিম্বা জগৎ

একটা মাত্রা জোড়া একটিই অক্ষর

বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিকই পূর্ণ সংসার



কাত্যায়নী


দশহাতে কাজ আর ফিরিস্তি লম্বা ভীষণ

তবুও অধরে হাসি, চোখ জুড়ে বসে আছে মায়া

আলো হাতে পার করা তমসার বুকে

একাই জ্বলে ওঠা

বেচালের সঙ্গে যে আপোষের সুযোগ থাকে না


ঝোপ বুঝে কোপ মারে সমাজের মাথা 

মুরুব্বি তুয়ে-বুয়ে কাজ হাসিল চায়, তাই

দশহাত দশ কাজ, হাত চলে একা

যন্ত্রণায় কাঁধ জোড়া টনটন করে







রাজা-এর গুচ্ছ কবিতা

ডার্ক চকলেট


জীবন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মেঘ ধেয়ে আসা রেস্তোরাঁ। সিগারেট ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে কুয়াশায়। কাউন্টারে কার লিপস্টিক গন্ধ ভাসে! আমি বরাবর মেঘ কুয়াশা মিলনকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মনে করে ফেলি। ক্ষমা করবেন, মহানুভব। বুক গহীনে যুদ্ধের আয়োজন। সাদা পায়রার ছটফটানি। খাদ কিনারায় দেখতে পাই পাইনবন রহস্য সমেত কেউ কেউ দৃশ্যহীনতা নিয়ে ঘরে ফেরে। কেউ অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। মিছিল থেকে পালিয়ে এসে চোখ কান বন্ধ রাখি। ব্যারিকেড চেনায় কচি বিপ্লবী। ধর্মাচরণ শেখায় চাড্ডী বানিয়ান। শুনুন, আমি তেমন ধর্মপরায়ণ নই। সকাল আটটার দার্জিলিং মোড়ে প্রিয় কবিকে অপেক্ষায় রেখে দিব্যি ঘুমোতে পারি, শরীরের পাশে অস্পষ্ট শরীর। নিশুতি ব্রীজ যেভাবে নিরুত্তর পেরিয়ে যায় ট্রেন, জোনাকি ছলনা মনে রাখে না সকাল, তেমন করেই হেলেয় যেতে দিতে পারি প্রাক্তনীর ছোবল, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতক আস্তিন। কাঠবিড়ালী-রাঙা সন্ধ্যা নামার আগে মৃতপ্রায় প্রজাপতির ডানা ভেঙে দিই। গাঢ় সবুজ ক্যানভাস উপত্যকা। মানুষ কেমন ব্যথা লুকিয়ে মেকি রঙ রেখে যায়। বাসি ফুলমালা, অবাক গোধূলি পাহাড়, না দেওয়া কথা-চুমু, অনেক না বলা বেঁচে থাকা। প্রেম এবং বিফলতা। সব শৈশব হারিয়ে যায় একটা অলৌকিক মাউথ অর্গ্যান প্রত্যাশায়। সমস্ত যৌবন অপ্রাপ্ত যৌন ইচ্ছায় ভোগে। বেশ্যা বাড়ির উঠোন-মাটি ভুলে থাকে দেবী প্রতিমা। বাজার দরে রুগ্ন ম্যাজিশিয়ান গলে যায়। ঈশ্বর ও ঘৃণার বিরুদ্ধে তবু সুরেলা বাঁশিওয়ালার পিছু নিচ্ছি না। জগৎ সভায় লিখছি না আরাম। শহর উৎসব, এসো প্রতিশোধে মাতি। আমার চাকরি খোয়ানো, বেকারত্ব, আসন্ন অনাহার নিয়ে উদযাপনে বসি এবার



হাইওয়ে


১.

খিদের মতো তেমন জরুরি কিছু নয়। এমনই কোনো সন্ধ্যায় সভাগৃহে ঢুকে পড়ি। মঞ্চের দিকে দৃষ্টি তাক করে একাকীত্বের ভয় লুকোই। আমার খুব সিরিয়াস মূকাভিনয়ে মাছির ঝাঁক ওড়ে। আর উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাঝ বরাবর কেমন সিগারেট সিগারেট পায়। তখনই নিকোটিন গন্ধে ভরে যায় ঘোষিকার মুখ। চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। মনে পড়ে ঘর নামক প্রহেলিকা থেকে এখনও আমার দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার। দুর্বল রসির ওপর ব্যালেন্স। মাদারীর ডমরু বেজে চলে। বাড়িওয়ালার দার্শনিক দূরবীন ক্ষুধার্ত জেগে থাকে সারাদিন 

      সারারাত


২.

প্রকাশকের গাঁজাময় চোখ, দূরদৃষ্টি আমার ভেতরেও সামান্য বারুদ সঞ্চার করে। ভাবি কিছু একটা করা দরকার, যাতে যাবতীয় অব্যবস্থাকে অল্প হলেও চমকে দেওয়া যায়। এমন সময় চায়ের গ্লাস সামনে রাখে হাতকাটা ভিখিরি। বাতানুকুল পরিবেশে তন্দ্রা জড়িয়ে আসে, শরীর ল্যাদ খায়। ঘুম এড়াতে জীবন স্ক্রল করে করে অনেকটা নিচে নেমে পড়ি। খবর, বিদ্বজনেরা জাবর কাটে। মন্ত্রীর ফ্ল্যাট, টাকা, রসালো গার্লফ্রেন্ড, মূল্যবৃদ্ধি কিংবা আচ্ছেদিন! এসবের সঙ্গে একটা সরাসরি যোগসাজশ থাকলেও বিপ্লব নামক গাঁজাখুরি গল্পে আমি ভুল মঞ্চ বেছে নিয়ে, ভুল অভিনেতার পোশাকে, ভুল সংলাপ বকে যাই 


৩. 

অপ্রকৃতিস্থ না হওয়া রাতগুলিতে দুই একলাইন বমি করে দিতে ইচ্ছে হয়। বিশেষজ্ঞরা 'ইহাকে কবির প্রসব যন্ত্রণা বলে ব্যখ্যা করিয়াছেন'। তাই যদি হয় তবে আমার কি মেনে নেওয়া উচিৎ,  আজ পর্যন্ত শুধু মৃত ও বিকলাঙ্গ সন্তানই গর্ভস্থ করেছি। এই বিষয় নিয়ে একদিন দড়ি হাতে সমালোচনায় বসা যাবে। আপাতত মঞ্চ আলো, আকর্ষণ। গভীর আলোচনায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে দেখি, দেখা আটকে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী পাছা, ঝুলে পড়া কোমর, বাসি তিল‌। এমন রগরগে মুহূর্তে কেন পুরুষাঙ্গ সাড়া দিচ্ছে না, সেটা ভাববার চেয়েও অশ্লীলতার দায় মোছা বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। কিছু ব্রহ্ম শব্দ খোঁজা প্রয়োজন। এই যেমন, পাছার বদলে নিতম্ব। বা হাগাকে হাগা না বলে পটি। তাতে দুর্গন্ধ কমে যায়। এইসমস্ত ভাবনার সাথে গায়িকার ধূর্ত নজর খেলা করে। গা ঘিনঘিন, ঘাম গন্ধ শুঁকে শুঁকে শেষমেশ হাইওয়েতে উঠে পড়ি। মাত্রারিক্ত সাবধানী হয়ে বাইকের গতি বাড়াই...



অশ্বত্থ ছায়ায় ---৩


ঘন বান্ধবী ঘোলাটে চাঁদ হয়ে নামছে সন্ধ্যা শহরে। এইসব অনাহুত সিনেমায় বোকার ভূমিকায় সাবলীল হওয়ার কথা ছিল। অথচ, কেমন ধূর্ত সেলসম্যান হয়ে ভাসছি নেশাতুর রাস্তায়। ঠিকানাবিহীন সেই চিঠি লেখা হল না। স্মৃতির প্রিয় মুখ পুড়ছে মোবাইল স্ক্রীনে। মায়ের আঁচলে বাঁধা মুক্তির চাবি চুরি করতে চাইছি নিজস্ব গোপনে। আমি কারো টিপের আয়না, কাজলের বিশ্বাস। স্বল্প সন্ন্যাসের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখে ফেলছি ছাদ জানালার অপেক্ষা মুখ। কখনো সখনো সংসারী হতে মন চায়। কোনো কোনো দিন আমিই শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ান। নষ্ট মেয়ের মতো আদর্শ ক্যানভাসে অবাক চোখ বেচেঁ থাকে। পাগলের ফেলে যাওয়া তাস কুড়োই বীভৎস ঘোরে। ছেলেবেলার ছবি চুরি হয়ে গেছে এমন নিটোল, গতজন্মকে ক্ষমা করে দিয়েছি অনায়াস। আড়াল শিখছি গাছেদের কাছে। এই জোনাকি আঁকা শরীর অভিশপ্ত, বুঝেছি ধার্মিক উচ্চারণে। দয়াল, তুমি তো খুব ভালো করেই জানো চালাকি, অন্ধত্ব ও ঘৃণা পেরিয়ে মধ্যরাতে যে হেরে যাওয়া লোকটা শব্দের আঁকিবুকি কাটছে অনন্তের খাতায়, সেই সামান্যই তার বুদ্ধ। সেটুকুই তার বিপ্লব



শ্মশান থেকে বলছি


শুধুমাত্র পার্টির রেকমেন্ডেশন পাইনি বলেই কি এমন অন্যের খোলসে বেঁচে থাকা? এসব বিতর্কের বিষয়। নিপুণ পলায়নে আজকাল উত্তর এড়িয়ে চলি। ফেরি করা পথে ঘাটে নির্লিপ্ত ভেসে বেড়াই। ভাবি, এই ফেরিওয়ালা জীবনী ততটা মিথ্যে নয়। সুতো ছেঁড়া ঘুঁড়ির মতো হয়তো আমারও কোনো ভূমিকা আছে। অভাব এক আদর্শ গান, একটু একটু করে দক্ষ বেকুব হতে শেখায়। বোকা শহরের বোকা বৃষ্টিতে বোকা বোকা ভিজি। ইহজন্ম পরজন্ম তালগোল পাকায়। অপেক্ষাহীন স্টপেজে ক্লান্তির বাস আসে,  অচেনা মুখের সারি। যে যার ঠকে যাওয়া দিগন্তরেখার দিকে চলে যেতে চায়। চশমায় ঝাপসা মেশে। তোমার অনিচ্ছাকৃত ফিরে যাওয়া দেখি। আমার ফিরতে চাওয়ার অসম্ভবে রাত্রি নামাই। রাতের গল্প ওড়ে হাওয়ায়। অভিশাপ ও পোকায় কাটা ফুল জড়ো হয় বিধান রোডের আশপাশে। শ্মশান বন্ধুরা সিগারেট ধরায়। আর জন্ম রহস্যের দিকে লেন্স তাক করে শকুনের দল। জেনে যায় হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকা যাদের মা নেই, টিকে থাকার জন্য তাদের বিষাক্ত উপমা আছে অনেক




তিতীর্ষা জোয়ারদার-এর গুচ্ছ কবিতা

তোমার সহিত কথোপকথন


মায়া?

-মায়া।

-তুমি বিভ্রম সৃষ্টি করছো কেনো?

- সুন্দরের দিকে তাকাতেই স্বরবর্ণ বলে উঠলো,"ক্ষ"।

সেই থেকেই ভুল শব্দ চিনি।

মাটির ওপর মাথা পড়তেই চলকে পড়লো জল,

শব্দ হলো, 

আমাকে বললো, ভ্রমের অপর নামই সৃষ্টি।

- তাহলে বাস্তব?

- মিথ্যা। ঠিক সুন্দরের মতন।

- সত্য?

- অসুন্দর। ঠিক প্রেমের মতন।

বাস্তবে নেই, বোধে আছে



ধাঁধা 


দুজন মানুষ মগ্ন হয়ে বসে আছে,

ভাবনায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দুটি হাত–


আলোর মতো প্রেম

রেললাইন পেরিয়ে একজনের গায়ের ওপর পড়লো,

অপরের গা ঢেকে দিল শীতল অন্ধকার


প্রথম জন গায়ে হলুদ মেখে বলে উঠলো,

আলোটি  এইবার নিজেকে ভালোবাসতে পেরেছে


 বর্ষার পর জল বেড়ে যায়

আলো কমে যায়

মৃত্যুর ঠিক আগেও, দেখা যায় লাল রং


অন্ধকার বেশিদিন বাঁচে


অপরজন তাই চাঁদের পাশে উবু হয়ে বসে থাকে।



আমি ও অপর 


সৌন্দর্য বেঁচে থাকায়,

আত্মহত্যার রং নীল

ছাইগাদা থেকে মানুষ তুলে

আমার আমিকে জড়িয়ে ধরি


আমি,

অপরের ছায়া মাত্র

বাদবাকি যত সুসময়

সকালের বারান্দা মুছে দিয়ে চলে গেছে

 সহস্র কপালের নীচে

এই কক্ষ তোমার জন্য বেঁচে আছে


জনশূন্য ঘরে একাকীত্ব কোথায়?




স্বাগতা-এর দুটি কবিতা

ব্যাকস্টেজ- ৯


আগুন নিজেই জ্বলে ওঠে। চাপ দিতে হয় না। কখনো সখনো শুধু মাটি ছুঁয়ে যাওয়া। যে যার ভাগ্যে খায়। কে কাকে খাইয়ে বড়লোক হয়? কারো ঔৎসুক্যে উৎকণ্ঠা খুঁজে, বা কারো বিশেষ দিনে একাকিত্ব মেপে, আবার কাউকে দূরদেশে চরম বিপদে পরিত্যক্ত করে কোনো কোনো মানুষ নিজেদের মহান পরিব্রাজক বানিয়ে ফেলে! সব দুঃস্বপ্ন অপমান গিলে, আমি শুধু হাসি। ব্যাকস্টেজ বলে "সত্য সেলুকাস!" ওসব করুণা টরুনার ধার ধারতে নেই। ব্যাঙাচির লাথ খেতে হয়। বলছি, অনেক তো হলো জোকারের নাটক! এসব ন্যাকা মেকি ইগো টিগো ছেড়ে আয়না কেনা দরকার। অন্যকে চিনতে আগে নিজেকে চেনা চাই। অন্তত "পয়সা দিয়ে কেনা মোবাইল" সেলফিতে চোখ রাখুন। "কিছুই ফেলে দিই না আমি, বয়ে বেড়াই" ঢং, আর কদ্দিন? শেষরাতে ধূসর জোনাকি ছটফট অ্যাশট্রেতে। মৃত্যু এতোটাই সহজ ও কঠিন। তার চেয়ে কঠিন ডিজিট্যাল যুগে ফেরারী হওয়া।


মজার ব্যাপার কী জানেন, এসব ঝাট জ্বালানো লেখা, চাইলেই লেখা যায়। কিন্তু আমি আপনি নই! 



ব্যাকস্টেজ ১১


বিপন্নতার পর শুধু ক্ষোভ লেখা হয়। এসো, এবার না হয় প্রেম লেখা যাক। যখ দিয়ে পলাতক প্রেমিক, তোমাকে বলি, তত গভীর করে ভাবো যারপর নিজেকে অচেনা শূন্য মনে হয়। অপবাদ ও অপমানের তীব্রতা অতটা নয়, যতটা তোমার ঘ্রাণ। ব্যাকস্টেজ জানে, যেসব পাহাড়ী বা আরণ্যক ম্যাজিক ছুঁয়ে ছিল উৎসব দিন, তাদের চেয়ে শক্তিশালী নয় কোনো যন্ত্রণা উপাখ্যান। শিল্পের দোহাইয়ে অতিসত্য কথন, তবু তুলে আনতে পারছে না কোনো অচীন শিশুমুখ সততা। হাতের রেখায় কারো নামের অদ্যক্ষর গাঢ় হচ্ছে খুব। শুধু আমি নিরুদ্দেশ হচ্ছি আরও। যে পথ বেয়ে ফিরে আসা যায় না আর কোনো মায়াবী স্নানঘরে। শব্দজলে এঁকে রাখছি সময়। গুঁড়ো গুঁড়ো কাচ, নেশা। ফুরিয়ে আসা শ্বাস। মুঠো খুলে মুক্ত করলাম যাবতীয় প্রজাপতি ও সান্ধ্য গান। শেষবেলার সূর্যরঙ মেখে ডানা মেলছে কবুতর দম্পতি। মিহি কুয়াশা চাদর জড়িয়ে উড়ে যাচ্ছি ছাদ পাঁচিলের ধার ঘেঁষে। মেঘপারের কোনো ভিনদেশে। যেখানে কেউ আমাকে আমার মতো ভালোবাসে। উড়ন্ত সব তারাদের আলো ভিখারীর আর্শিতে লেগে আছে। আজান পথে চোখ রেখে আছি, ব্যথাদের নির্বাণ দিতে চেয়ে। যা কিছু লিখছি, আর যা লেখা হবে না, তার প্রতিটা অক্ষর বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছি অন্তরীণ ভিতরে। শুধু সন্ধ্যাদীপ আগলে রাখছি দু'হাতে, কোনো এক সময়োচিত সুসংবাদের প্রতীক্ষাতে…





সৌরভ মজুমদার-এর গুচ্ছ কবিতা

বিষাদবালিকা ও ভার্চুয়াল স্পর্শ



ষড়যন্ত্র শব্দটি শুনলে রাজাদের আমলে ফিরে যাই। ইতিহাসের পাতা থেকে ধার করি উপমা। কোনো এক নাম না জানা নগরীর রাজকুমারী হিসেবে তোমার ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করি। তোমার খোলা চুলে কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া। শরীরে সমুদ্র নীল কাপড়।চারিদিকে জারুলের ফুল। মোমবাতির ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখছি নিষ্পলক। একদিন ধরা পড়লাম।শাস্তি হল আমার। পাপ সঞ্চয় করে

মোক্ষ হারালাম। থেকে গেলাম পৃথিবীতে যাবজ্জীবন। প্রতিবার তুমি আসলে অবহেলা নিয়ে। এদিকে আমি, 

পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্র মুছে দিচ্ছি ধীরে ধীরে।



 ভালোবাসা হল ভ্রম। এই সহজ সত্যি থেকে সরে সরে থাকা। তুমি কিছু তত্ত্ব খুঁজে আনো। আমাকে বোঝাও। তোমার সাথে তর্ক করার চেয়ে হেরে যাওয়া ভালো। তুমিই ঠিক। আমাকে ব্যবহার করো। এতে কোনো দোষ নেই। ছাড়পত্র হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আপেল বাগানের দিকে। তুমি সব বুঝে যাচ্ছো। টিলার ওপর বসে নক্ষত্র ভরা রাত। তোমার প্রিয় রঙ- রাতের আকাশ। প্রিয় দুঃখ- ভ্রম। আমি তোমার সাধক হতে চাই।দিয়ে দাও দুঃখের বাগান। দাও মৃত্যুর আদর। দাও শোকের আগুন। দাও ব্যথার বরফ। শুধু নিও না ভালোবাসা। সাধক আর প্রেমিক আলাদা রাখা ভালো।


১১


আজ রাতে সুযোগ পেলে আমি ঈশ্বর হয়ে উঠবো। তোমাকে বলে দিলাম সালমা হায়েক। 

অতএব বেহায়া হও। হয়ে ওঠো মরুঝড়। 

ঊরুর কাছে আত্মসমর্পণের অধ্যায়। 

তোমার বুকের কাছে পারফিউমের খনি। 

একটি অদৃশ্য পেনডেন্ট থেকে ঝুলছে আমার নাম।এখন চন্দ্রকোষের সময়।তাও মেক্সিকোর গ্রামে বসে। 

চারিদিকে স্মাগলারের দল। ড্রাম বাজছে।

 তোমার শরীরি বিভঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত রাত।

সামনে ফায়ার প্লেস। 

তোমার আগুন দিয়ে পোড়াও এই হৃদয়। 

জাপটে ধরো চাঁদ।

 রাত পেরিয়ে গেলে আমি বাহাত্তর বি বাসের নিত্য যাত্রী। 

তুমি সালমা থেকে সাধারণ।


১২


এবার থিতু হই। গুছিয়ে বসি। 

তোমার কথা শুনি।

 তুমি বললে বাঙ্ময় নীরবতা। 

তারপর কত সন্ধ্যা ডুবে গেল দীঘির জলে। 

খামোখা কেটে গেল সময়। 

পাহাড়ের ঢালে যে জঙ্গলটা ছিল 

তোমার পছন্দের-

ওখানে এখন রিসোর্টের শিলান্যাস।

 কিছুদিন লিফলেট,অবস্থান বিক্ষোভ গেল।

 তোমার মুখে রডোডেনড্রন হাসি। 

সাতদিনের মাথায় টিয়ার গ্যাস-

পিঠে লাঠি, পিঠে ব্যথা। 

এসো ভিতু হই,পালিয়ে বাঁচি। 

লিখে রাখি ব্যর্থতার অজুহাত

তোমার আঙুল ছুঁয়ে। 

চেষ্টার পরে যা কিছু আমাদের হাতে নেই

তা সবটা হাতের রেখায় থাকে



গল্প//-


অগ্রদীপ দত্ত-এর গল্প

প্রদীপ 


পাড়ার মোড়ে এসে দাঁড়ালেন সৌম্যরঞ্জনবাবু।

পুরো পাড়া জুড়ে আলোর বহর। ছাদ কার্নিশ ব্যালকনি এমনকি বাগানের গাছগুলো অবধি টুনি লাইটের আলোয় এমন সেজে উঠেছে যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। একটু আগেই বাজি ফাটানো হয়েছে এই গলিতে। বারুদের গন্ধটা মায়ের শরীরের গন্ধের মতোই আদুরে। কীভাবে যেন হাওয়ায় মিশে থাকে অনেকক্ষণ। সৌম্যরঞ্জনবাবু বুক ভরে শ্বাস টানলেন। আহহ! শব্দটা অস্ফুটেই বেরিয়ে এল মুখ থেকে। চারিদিকের রোশনাই আর বারুদের গন্ধে চোখে জল চলে এল তার।


পাঞ্জাবীর ময়লা হাতায় চোখের কোণ মুছে ধীর পায়ে এগোতে লাগলেন সামনের দিকে। সব বাড়ির পাঁচিলে, সদরের সামনে টিমটিম করে জ্বলছে প্রদীপের আলো। আজ ভূতচতুর্দশী। পূর্ব-পুরুষেরা আজ মর্ত্যে নেমে আসেন। ছোটবেলায় বাবার সাথে বাড়ির সমস্ত কোণে প্রদীপ দিতে গিয়ে দুষ্টামির কথা মনে পড়ে গেল সৌম্যবাবুর। নিভে যাওয়া প্রদীপগুলো অন্যের বাড়ির টিন তাক করে ছুঁড়ে মারতেন বন্ধুরা মিলে। পাড়াশুদ্ধু  লোক ভয় পেত ভূতের। তখন কী আর জানা ছিল দিনটার গুরুত্ব!


রাত সাড়ে ন'টা। অথচ পুরো গলি ফাঁকা দেখে একটুও অবাক হলেন না সৌম্যরঞ্জন। পাড়ার অপর প্রান্তের মোড়ে এখন নিশ্চয় সবাই ব্যস্ত পুজো মন্ডপ সাজাতে। লাট্টু, বিমল, শক্তিরা এতক্ষণে ঠাকুর আনতে চলে গেছে রেললাইনের পারে। সারাবছর ব্যাটারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ালেও পুজোর কয়েকটা দিন ভীষণরকম সিরিয়াস। মালঞ্চ সংঘের বরাদ্দ কাজের অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ের আগে করে ফেলে বরাবর। 


মালঞ্চ। নিজের মেয়ের নামেই পাড়ার ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন সৌম্যরঞ্জন। পুজোর কয়েকটা দিন কী হৈ-হুল্লোড়েই না কাটে! পাড়ার একমাত্র কালীপূজা বলে কথা। মিষ্টি, শিমূল, ঝিনুক, পাপড়িরা প্রতিবারই গ্রুপ নাচ করে। শ্যামলের মেয়ে তুলতুল স্টেজে উঠে অর্ধেক আবৃত্তি করে এবারও আটকে যাবে, দোলনের ছেলে বাপ্পা দিনরাত মাইক টেস্টিং, মাইক টেস্টিং চেঁচিয়ে মাথা নষ্ট করবে সবার, আর শ্যামাসংগীত বাজানো নিয়ে চিন্ময় বসাক- স্নেহাশিস তালুকদারের সেই ট্র‍্যাডিশনাল ধুন্ধুমার। এই বিরক্তিকর জিনিসগুলোই এখন বড্ড আপন মনে হয় সৌম্যরঞ্জনের। 


মঞ্চ বানানো, মূর্তি আনা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা, কেউ বলার আগে সমস্তটাই করে ফেলতেন তিনি। সে-ও এক দিন ছিল বটে!


কিছুদূর এগিয়ে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন সৌম্যবাবু। বাড়িটা একইরকম আছে। আধো অন্ধকার। ব্যালকনির পাশ দিয়ে একখানা টুনির চেন কোনোমতে ঝুলে আছে নীচে। মা-মেয়ে এরচেয়ে বেশি আর কী-ই বা সাজাতে পারবে। মেয়ে ও স্ত্রী এর মুখগুলো দেখার খুব ইচ্ছে হল সৌম্যরঞ্জনবাবুর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গেট খুলে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালেন ভেতরে। 


সামনের পাঁচিলে চোদ্দো-বাতি দেওয়া। পূর্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে। চার বছর আগে মারা যাওয়া মালঞ্চের বাবার উদ্দেশ্যে।সৌম্যরঞ্জন নিজেকে সামলাতে পারলেন না। রাগের বশে একেরপর এক প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে একখানা তুলে নিলেন হাতের মুঠোয়। তিনি তো বেঁচেই আছেন। নিজের না হোক অন্যের শরীরের খোলসে। একে কি বেঁচে থাকা বলে না? তাহলে কেন এই প্রদীপ?


পাড়ার পুজোর মায়া ত্যাগ না করতে পারা সৌম্যরঞ্জন প্রত্যেক বছরই ফিরে আসেন। ভূতচতুর্দশীর রাতে। মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। প্রতিবারই আলাদা আলাদা মানুষের শরীরে। এবার যেমন এক মৃত ঢাকির দেহে পাঠানো হল তাকে, আগামীকালের পুজোর কথা-বার্তা বলতে।


নিজের মেয়ে বৌকে চোখের সামনে দেখলেই সবকিছু উলোটপালোট করে ফেলেন সৌম্য। আগেরবার মালঞ্চকে যখন দেখলেন তার উপহার দেওয়া পুরনো একখানা সালোয়ার কামিজ পরে ফুলের মালা গাঁথতে, খুব খুব ইচ্ছে করছিল বুকের মধ্যে জড়িয়ে  নিজের পরিচয়ের সবটুকু উগড়ে দিতে। 


কিন্তু না। এসব কিছুই করতে পারেন না। নিয়ম নেই। এই জগতের মতোই ভূতেদের জগতেও কিছু নিয়মকানুন আছে। সেগুলো অমান্য করলেই আর মানুষ-শরীর ধারণ করতে পারবেন না সৌম্যরঞ্জন। 


তাই মাথায় চেপে বসা দেখা করার অদম্য ইচ্ছেটাকে কোনোমতে দমিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলেন তিনি। পুজো মন্ডপে বোধহয় মা-মেয়ে ইতিমধ্যে চলে গেছে। কাছ থেকে না হোক, দূর থেকেই ভালো। সৌম্যরঞ্জনবাবু অসীম উত্তেজনায় ক্লাবের দিকে এগিয়ে গেলেন। 


শুধু যাওয়ার আগে মুঠোয় চেপে ধরা প্রদীপটা ব্যালকনি তাক করে ছুঁড়ে মারলেন সজোরে।


*****


জানলার কাচে দুম করে একটা শব্দ হতেই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন সংগীতা। পাশে মালঞ্চ টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে। 


সামনের পাঁচিলের প্রতিটা বাতিই নেভানো। প্রথমে ভাবতেন হাওয়া। কিন্তু তারপরে আশপাশের বাড়িগুলোর জ্বলন্ত প্রদীপগুলো দেখে মনের ভেতর সন্দেহের খচখচানি উঁকি দিত সবসময়। অনেকটাই পরিষ্কার হল যেইবার থেকে প্রদীপের ঢিল আসা শুরু হল বারান্দায়।


টর্চের আলোয় প্রতিবারের মতো পাওয়া আধ পোড়া প্রদীপের টুকরোগুলো মেঝে থেকে পরম যত্নে কুড়িয়ে কাপড়ের ব্যাগে ভরে নিলেন সংগীতা। 


তিনি জানেন প্রতি বছর ভূতচতুর্দশীর রাতে পাড়ায় একটা বাড়িতেই ঢিল এসে লাগে কাচের জানালায়। ধাক্কা লেগে চূর্ণবিচূর্ণ হয় মাটির প্রদীপ। 


কারণ ঢিল ছোঁড়ার গল্পটা তার ভীষণ ভীষণ চেনা...।




প্রবন্ধ//-


পুরুষোত্তম সিংহ

কবিতার শত্রু মিত্র 


কথাকার অমর মিত্র কবি। তিনি কথাসাহিত্যের কবি। অমর মিত্রের উপন্যাসভুবন থেকে কবি অমর মিত্রকে আবিষ্কার করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। আসলে নিজস্ব ভাষাবল ও স্নিগ্ধ বাক্যজালে কাব্যময়ভুবন নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। গদ্যের স্বচ্ছ অনাবিল প্রবাহ ও মায়াময় পরিচ্ছেদ বিন্যাসে লিরিকের সংমিশ্রণ আখ্যানকে বহু পরিসরে কাব্যসত্যে উত্তীর্ণ করেছে। কবি, কবিতা, লিটল ম্যাগাজিনের দায়বদ্ধতা, কবিতা পত্রিকার জীবনসত্য, কবির পাগলামিকে সামনে রেখে লিখেছেন ‘নতমুখ চরাচর’ উপন্যাস। গৌতমবুদ্ধকে (বীরেন মণ্ডল) সামনে রেখে কবিতা সংসারের চৌহদ্দি নির্মাণ এবং কবির পারিপার্শ্বিক কাব্যবলয়কে (অবন্তিকা, সেলিম, চন্দন) রহস্যজালে বাঁধার এক নতুন পরিসর, যা উপন্যাসভুবনে ম্যাজিক 

এ যেন এক কবির দেশ। কবির অনুভূতির ভুবনময় চিত্রশালা। কাব্য সাম্রাজ্যেও যে নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারিত হতে পারে, সত্যদ্রষ্টা কবিই যে সভ্যতাকে প্রকৃত পথ দেখাতে পারে সেই বয়ান। কবিতার সত্য, কবির দায়বদ্ধতা, কবির বর্ম, সমাজ চিন্তা ও মানবিক ভাবনা নিয়ে চরাচরের অকথিত সত্যের খুঁটিনাটির অসমান্তরাল বিন্যাস। কবিতার দর্শন, পাগলামি, ভবঘুরে চিন্তা, দিকশূন্যপুরের অভিলাস নিয়ে এ এক মায়াময় আখ্যান। কবি মানেই উদাসীন পাগল, বাউলশক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার থেকেও বহেমিয়ান জীবনযাপন পাঠককে বেশি আকর্ষণ করেছে।

    এ আখ্যান গৌতমবুদ্ধ নামে এক কবির ঘর সংসার। প্যাশন, জীবনচিন্তা, কাব্যভাবনা, লিটল ম্যাগাজিন, কবিতার উৎসভূমি নিয়ে একলা মানুষের হইহই কোলাহল। আপাত দৃষ্টিতে পাগল মনে হতে পারে কিন্তু গভীর জীবনতৃষ্ণায় সেই বয়ান ভেঙে যায়। বলা ভালো আপতিক জীবনচিন্তার পরিসর লেখক ভেঙে দেন। এ যেন কবিতার সঙ্গে ঘর গেরস্থি। যাবতীয় কথাবার্তা জীবনবোধ, জীবনবিন্যাস, ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান ভালোবাসাবাসি সব কবিতাকেন্দ্রিক। এই গদ্যে একটা লিরিক আছে। একটা সুরেলা প্রবাহ আছে। ছন্দের দোলাময় বাক্যস্রোতে কাহিনি ভেসে গেছে কাব্যসাগরে। ছন্দের দোলায় রাষ্ট্রের দাসত্ব, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সবই আছে। কবির ধর্ম, কবিতার ধর্ম বজায় রেখেও কল্পনায় ভেসে যাবার আকাঙ্ক্ষা আছে। এ এক মিস্টিসিজমের উপন্যাস।

    এ এক কবিতার মেলা। প্রবীণ কবি, নবীন কবি। কবিতা দপ্তর। কবিতা ক্যাম্পাসউল্লাস, হইহল্লা। আসলে অমর মিত্র নিজেও এক প্রাণবন্ত মানুষ। হইহই করা উত্তাল স্রোত আখ্যানে তীব্র গতি সঞ্চার করে। নির্জন কবি, দলবাজির কবি, দলছুট কবি, পথহারা কবি। কত কবি এই চরাচর থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা পড়িনি, জানিনি। অথচ অসম্ভব ভালো কবিতা লিখত। এই উপন্যাস কবিতা কালচারের উপন্যাস। কবিতার মায়াভূমিই এই আখ্যানের প্লট নিয়ন্ত্রক। ভেজালহীন উন্মাদ গৌতমবুদ্ধ। রহস্যময় অনেকান্তিক উদ্ভট চিন্তা করে চলেন। কবি বলেই তা সম্ভব। তেমনি কবিই এই মহাপৃথিবীর ঈশ্বর। মহাপৃথিবীর ভিতর আরেক জগৎ নির্মাতা। বিকল্প ভাবনার দিশারী।

    কবিতার সত্যভূমি থেকে আধুনিক কবি অনেক দূরে সরে এসেছেন। নিভৃত সাধনা, কবিতাচর্চা অপেক্ষা দলাদলি, সিন্ডিকেট বড় হয়ে উঠেছে। প্রকৃত কবিকে প্রমোট করার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অহম সর্বস্ব মানসিকতা বাংলা কবিতার সমূহ সর্বনাশ করেছে। অবন্তিকা, গৌতমবুদ্ধের মধ্য দিয়ে লেখক আসলে কবিতার নান্দনিক চালচিত্রের গভীর বলয়ে প্রবেশ করেন। কত কবি লিটল ম্যাগাজিনেই হারিয়ে গেছে। বাণিজ্যিক প্রকাশনী দায়বদ্ধতা পালন করেনি। প্রতিষ্ঠিত কবি সার্টিফিকেট দেয়নি বলে বই হয়নি। তবে সব হারিয়ে যায়নি। কেউ কেউ মনে রেখেছে। বহু পরে আবিষ্কার করেছে। পড়েছে। সত্য উচ্চারণ করেছে। বিনয় মজুমদার, শম্ভু রক্ষিত, তুষার রায়। আমাদের আবহমান সাহিত্য তথা কবিতা চর্চা ভণ্ডামি, দলবাজিতে ভর্তি। প্রকৃত সত্য বলার লোক নেই। বললে তাকেও সেম সাইডে গোল খাইয়ে দেওয়ার ক্রমবর্ধমান চেষ্টা চলছে।

    এ এক সাংস্কৃতি বয়ান। সমাজ পরিবেশ পরিস্থিতি সহ গত শতকের সাতের দশকের উত্তাল আবহ, সময়ের জটিলতা, রাজনীতি ও ব্যক্তি মানুষের দ্বিরালাপ। কবিমনের অনুভূতিতে সব দেখা-বোঝা-জানা। আবেগ রোমান্টিসিজম বলতে বলতেই জীবনের ভিতরে, সময়ের ভিতরে উঁকি ঝুঁকি দেন। কেন এই আখ্যান লেখার প্রয়োজন হল এই কুজ্ঝটিকাপূর্ণ সময়ে? কবি তার দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসেছেন। কেন কবিতা লিখি এই বয়ানে বিবিধ জবাবদিহি উঠে আসে। ভালোলাগা, আনন্দ দান, কাজ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কবিতাই তো দেশকে, মানুষকে পথ দেখাবে। কবির সেই সমাজচেতনা, দায়বদ্ধতা অস্তগামী হয়েছে। জীবনের বেলাভূমিতে কবিতা কোন পথে যাত্রা করবে? বিষাদময় সময়ে, সন্ত্রাসের পটভূমিকায়, রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে কবি ও কবিতা কতখানি গ্রহণযোগ্য তার হিসাব নিকেশের পক্ষ-বিপক্ষের আখ্যান ‘নতমুখ চরাচর’।

    গত শতকের ছয়ের দশকে কবিতা আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। আবহমান কবিতার পরিসর থেকে নতুন উৎসে যাত্রার প্রবণতাই প্রধান ছিল। প্রচলিত সত্যকে ভেঙে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। সেসময় কবিতায় প্রবল জোয়ার এসেছিল। প্রথাগত পরিসর ভেঙে সামান্য মানুষও কবিতায় আশ্রয় নেয়। জীবনের মর্মমূলের বোধকেই প্রকাশ করতে চান। সেই ছয়ের দশকের কবিতা আন্দোলনের সময় গৌতমবুদ্ধ যুবক। স্বভাবতই কবিতার মায়াবী রূপমোহ হৃদয় ছুঁয়েছিল। কলকাতা কেন্দ্রিকতা থেকে কবিতার সরস্বতী দূরে গেছে। তবুও মানুষ সাহিত্যের জন্য আজও কলকাতামুখী। লেখক সময়ের অলিগলি ধরে সাহিত্যের হালচালের খবর দিতে থাকেন। কবিতার জন্য জেল যেমন সত্য হয়ে দাঁড়ায় তেমনি বন্দিমুক্তির কবিতা রচিত হতে থাকে। একজন কবিকে সাতের দশকে কবিতার জন্য জেলে যেতে হয়েছে। এমন বহু কবিই আছেন। আজও ভারাভারারাওদের জেলে যেতে হয়। সভ্যতা কবিকে ভয় পায়, সেই সত্যনিকেতনের সদর দরজা লেখক খুলে দিয়েছেন।

    গত শতকের সাতের দশকের রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে আজকের বাংলা কবিতার বাজারে আখ্যান পরিক্রমা করেছে চক্রাকারে। কবিতা নিবেদিত গৌতমবুদ্ধ, মহাজাগতিক তার গাণ্ডিবসারথি অবন্তিকা। আপাত লিরিক কাব্যস্রোতের মধ্য দিয়ে কবিতাভুবনের যাবতীয় সত্য বের করে আনেন। বাংলা কাব্যের ইতিহাস লেখার এ যেন নতুন ঢঙ। কথাকারের কল্পনার চোখে কাব্য আন্দোলন, কবি জীবনের বাস্তবতা দেখা ও সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির নিরূপণ। রাষ্ট্র ক্রমেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। কবির সত্যচিত্রের কণ্ঠরোধ করতে সিদ্ধহস্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যকে গলাটিপে মারার যে ভয়ংকর দুর্দিন এসে উপস্থিত হয়েছিল সেই সময় বিভীষিকা আখ্যানে গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্র যতই সাহিত্যকে কণ্ঠরোধ, কবিতার সত্যে চাবুক চালাবে ‘নতমুখ চরাচর’এর মতো আখ্যান ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, চিরকালের সত্যে পর্যবসিত হবে।

    আখ্যানে পুলিশ বনাম কবির লড়াই বড় চমৎকারভাবে রূপায়িত হয়েছে। বিষয়ই স্বতন্ত্র করে তুলেছে আখ্যানকে। যা নকশাল পর্বের ইতিহাস, সেই সত্য ভিন্ন বয়ানে উপন্যাস সত্যে আলোড়িত হয়েছে। নির্মাণ-বিনির্মাণ প্রক্রিয়া এভাবেই আখ্যানকে আধুনিক করে তোলে। এই চরাচর কবিতাময়। নিসর্গভূমি যেন কবিতার সূতিকাগার। খুঁজে নিতে পারলেই কবিতার জন্ম হবে। চাই ভাষা বয়নের দক্ষতা। কবিতার স্বপ্ন, পত্রিকার স্বপ্ন মানুষকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখে, জীবনের তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণা, লজ্জা-ঘৃণা, ব্যর্থতা সব ভুলিয়ে কীভাবে নতুন প্রেরণা দেয় বাঁচার, আখ্যান সেই সত্যে উপনীত করে পাঠককে।

     আখ্যানভূমিতে মায়াবাস্তব, পরাবস্তব, অলীক বাস্তব, ফ্যান্টাসি, রোমান্টিসিজম মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। গত শতকের বইছাপা, ছাপাখানা-পত্রিকা সহ বয়ানে লুকিয়ে থাকে বইপাড়ার অচেনা পরিসর। এ এক কবির আত্মকথা, কবিতার আত্মকথা। মহাজাগতিক জীবনময় কবির বেঁচে থাকার জীবনদর্শন। কিছু না পেয়েও, সব ত্যাগ করেও পাগলামিকে নির্ভর করে যে বাঁচা যায়, কিছু মানুষকে ভাবিয়ে তোলা যায় এ আখ্যান সেই চেতনাবলয়ের মণিমুক্তা। ছাপাখানা নির্ভর বিগত সময়ের পত্রিকার হাদিসনামা, সাহিত্য-পত্রিকা-কবিতা সবটাই উদ্দীপনা, সেই জীবনবোধে লেখক পৌঁছতে চেয়েছেন বারবার। প্রাণভ্রমরা ভর না করলে সাহিত্য অসম্ভব। সেই প্রাণভ্রমরাই গৌতমবুদ্ধকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

    নকশাল আন্দোলন পর্বে তিমিরকান্তি ঘোষ, দ্রোণাচার্য ঘোষদের মৃত্যু ঘটেছিল। সেই আভাস আখ্যানে রেখে লেখক কবিতার তত্ত্ব, জীবনবোধ, রাষ্ট্রীয় বেড়াজালে বন্দি কবিতার শত্রু, কবির আত্মগত জগৎ, কবিতার সত্য, চরাচর জুড়ে কাব্যভুবনের অলংকার, কবির মায়াভূমি-ভাবভূমি, কবির বিবিধ সত্যে যাত্রা নিয়ে এ এক কাব্যের জলাভূমি। কাব্যের মণিমুক্তা যেমন কাব্যপাঠে উঠে আসে তেমনি কবির আত্মদর্শনের ভিন্ন বয়ান এই আখ্যান। অমর মিত্রের লেখার বড় বৈশিষ্ট্য মায়াবী ভাষায় আখ্যানভুবনে ঘোর তৈরি করা। একই বৃত্তে অজস্র কথাজালে ঘুরতে ঘুরতে কথাচক্র সৃষ্টি করা। একই কথার নানা বৃন্তলগ্ন পুনরাবৃত্তি করে মূলসত্যকে ভিন্নপথে প্রতিষ্ঠা করা। ব্যতিক্রম নয় এ আখ্যানও। তিনি অসম্ভব গল্প বানাতে জানেন। বাস্তবের ভিতর অবাস্তব, কাহিনির ভিতর উপকাহিনি, চরাচরের নগ্ন সত্যের মধ্যেও পাগলামি ঢুকিয়ে এক আশ্চার্য জগৎ গড়ে তোলেন। যা আপাত অর্থে বাস্তব আবার বাস্তবের ঊর্ধ্বে। আসলে জগতে কত প্রকার সত্য, জীবনবোধ রয়েছে যা আমাদের জানা সম্ভব নয় তাই তিনি নির্মাণ করেন। কবিতার ভিতর কবিতা, পত্রিকার ভিতর পত্রিকা এনে সাহিত্যের ভুবনময় সংগীত বাজিয়ে যান।

    আখ্যানভুবনে ফেলে আসা সময়ের ছাপাখানার ভূতগুলি বারবার বেজে উঠেছে। স্মল পাইকা, পাইকা বোল্ড, স্মল পাইকা বোল্ড। নতুন সময়ের মানুষের কাছে এ এক অচেনা পরিসর। এইভাবে সামাজিক ইতিহাস লিখিত হয়। কবি গৌতমবুদ্ধ চরাচরকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করতে চান। কবির জগৎ থেকে বাস্তব জগতের অমিল অনেক। অর্থকারী মানুষ, ভোগী আত্মস্বার্থ মানুষ কবির চেতনা বোঝে না, একজন কবিকে পাগল বলে চিহ্নিত করে, কবি সভ্যতার কাছে বিদ্রূপ পেয়ে নিঃসঙ্গ হয়। সভ্যতার চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। নকশাল আন্দোলনের ডাক দিলেও বিপ্লব হয়নি। সমাজ পরিবর্তন হয়নি। ক্রমে সরকার সব নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য থাকেনি। ক্ষমতাবাণ আবার সব দখল করে নিয়েছে। গিরিধারী অধিকারীরা বিপ্লবের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়ে ভালুকচরায় চলে গিয়েছিল।

    এ আখ্যান যেন কবিতার শত্রু-মিত্র। সাতের দশকে রাষ্ট্র কবি-কবিতার ধ্বংসসাধনে মেতেছে, অন্যদিকে কিছু মানুষ কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেএই দুই সত্য, দোলাচলের মধ্য দিয়ে কবি-কবিতার যাত্রাপথের সন্ধ্যাকালীন রোমান্টিক নীরব ভাষ্য আখ্যানে উঁকি দিয়েছে। রাষ্ট্র নিজস্ব মানচিত্র থেকে কবিতাকে মুছে ফেলতে চেয়েছে কেননা কবিরাই সভ্যতার বড় শত্রু, সভ্যতার ক্ষয়ক্ষতি কবিরাই চিহ্নিত করতে সক্ষম। অন্যদিকে স্রোতের বিপরীতে, ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে আত্মগোপন করে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখার জেহাদ পদাবলি এ আখ্যান। কখন গড়ে উঠবে কবিতা? কখন আসবে কবিতা লেখার প্রকৃত সময়? দেখে নেওয়া যাক আখ্যানভুবন—

“মানুষ সব মেরে খেয়েছে। না হলে মেরে আনন্দ পেয়েছে। ধরে ডানা ছেঁটে দিয়েছে যাতে উড়তে না পারে। খাঁচায় ভরেছে। একদিন পাখিরা খাঁচা বানিয়ে মানুষকে পুরে দেবে তার ভিতর। খাঁচার সামনে এসে বাঘ সিংহরা ভয় দেখাবে। সব কামান, বন্দুক তারা মুখে করে নিয়ে গিয়ে গাঙে ভাসিয়ে দেবে। হলদি নদী দিয়ে ভেসে যাবে খড়কুটোর মতো যত বন্দুক, পিস্তল, বোমা আর সাঁজোয়া গাড়ি। এসব তাঁর কথা নয়। মহাকবি কালিদাসের কথা। তখনই আসবে কবিতার মুহূর্ত।”

 এই ভুলভুলাইয়া ভুবনজোতে কত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, ভগ্ন, সত্য-অর্ধসত্য, বিকৃত সত্যের কবিতা পড়ে রয়েছে। পরশপাথরের পাগলের মতো খুঁজলেই কবিতা পাওয়া সম্ভব। এ পৃথিবী কবিতাময়। নিসর্গ কবিতাকেন্দ্রিক। জীবনজগৎ কবিতার মাতৃভূমি। চরাচরে আঘাত না করে, কিছু নষ্ট না করে চোখ খুলে দেখলেই কবিতার বিন্দু বিসর্গের খোঁজ মিলবে। চরাচরের প্রান্তে যে কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা আমরা ফেলে এসেছি, ইট কাঠের বিপরীতে যে চাষবাসকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনের সতেজ উষ্ণতা যা আসলে সভ্যতার প্রাণ সেই জীবনবীক্ষণই এই উপন্যাসের প্রাণভূমি। আখ্যান শেষপর্যন্ত মানবিক বোধের আখ্যান হয়ে উঠেছে। কবিতা মানুষকে শুভবোধে নিয়ে যায়। মানুষের ভুলত্রুটি, সভ্যতা-রাষ্ট্রের শোষণ-লাঞ্ছনা ক্ষয়ক্ষতি চিহ্নিত করে মানুষকে এক শুভ বোধের চেতনায় ফিরিয়ে আনে। এই আখ্যানও সেই ভূমিকা পালন করে চলে।

    সভ্যদেশ, নগর, রাষ্ট্র, পুলিশতন্ত্র থেকে শেষ পর্যন্ত কবির নির্বাসন ঘটে। অমর মিত্রের আখ্যানে নির্বাসন বারবার সত্য হয়ে ওঠে। অচেনা অজানার উদ্দেশে পাড়ির মধ্য দিয়ে আখ্যান অনন্ত ব্যাপ্তি লাভ করে। লেখক আখ্যানকে ভূখণ্ডে না বেঁধে মেঘের মতো চরাচরা ভাসিয়ে নিয়ে যান। ভাসমান অক্ষিগোলায় যে কাব্যসত্যের বেলাভূমি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা মানুষই হয়ে ওঠে কাব্যদ্বীপের নিয়ন্ত্রা সেই রহস্যময় আলো-আঁধারের রোমন্থন আখ্যানকে অলীক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে অন্য রাজ্যে অন্যরাজ্যে নিয়ে যায়।



তথ্যসূত্র :

১. নতমুখ চরাচর, অমর মিত্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল ২০২২, পৃ. 

   ১০১।

** স্মৃতিহীন বাঙালির স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থ নামেই প্রবন্ধের শিরোনাম করেছি, মাননীয় পাঠক আপনার অসুবিধা হলে শিরোনাম হিসেবে ‘কবিতার সাইলেন্ট জোন’ মনে মনে বসিয়ে নিতে পারেন।


















বিরতির পর ; সংখ্যা ১৭|| বর্ষ ৩|| পর্ব ১

  যাঁরা লিখলেন:-   একটি কবিতা : শৌভিক রায়, রুপক সান্যাল, শুভ্রদীপ রায়, পঙ্কজ ঘোষ, উজ্জ্বল বর্মন, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, মধুমিতা বস...