বিষয় - বই আলোচনা-সংখ্যা ১৬ বর্ষ ২







একটি নামমাত্র সম্পাদকীয় :-

এই সংখ্যার ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় বোকামির সমান মনে করে সম্পাদকীয় লিখবো ভেবেও লিখতে পারলাম না। কিছু বিশেষ গ্রন্থের আলোচনা করলেন আলোচকেরা।সঙ্গে দুজনের কবিতা আর একটু চিত্রপ্রদর্শন ব্যস।একটা ককটেল হাজির করলাম আপনাদের সামনে। যা ইচ্ছে তাই করুন, পড়ুন পড়ান পছন্দ হলে মতামত জানান অপছন্দ হলে রিপোর্ট করুন যা খুশী করুন। ও হ্যাঁ আরও একটি কথা।সম্প্রতি ১৮/১৯ সেপ্টেম্বর মালদা শহরে আয়োজিত উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমির আয়োজনে 'ওয়েবজিন প্রদর্শনী'-এ ওয়েব ডুয়ার্স সহ আরও অনেক ওয়েবজিন অংশগ্রহণ করেছিল।সবাই সবার ওয়েবজিন পাঠক,আলোচক সবার সামনে তুলে ধরলেন।আমরাও তুলে ধরলাম আমাদের বিগত কিছু কাজ,আগামীর কিছু লক্ষ্য আর বাকিটা পরবর্তী সংখ্যাগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন।উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমিকে এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।আরও যে কথাগুলো না বললেই নয় তা হলো আমরা কথা কম কাজ বেশি এ কথায় বিশ্বাসী।ভালো থাকুন ভালো রাখুন, পড়াশোনায় থাকুন প্রেমে বাঁচুন ...

Artist - Bishwajeet Ray



সাহিত্য সমালোচনা :- 


পারমিতা ভট্টাচার্য

গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে



"ধর্ষকামে মত্ত ছিল তারা.....
....ও বোন কবিতা তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?
এ যদি উপমা খোঁজে, বাকিগণ রূপক সন্ধানী
এ যদি কৈবল্যবাদী, বাকিগণ ছন্দবিশারদ
এ যদি শৃঙ্গার প্রিয়, বাকিগণ সঙ্গমবিলাসী......"
                                     (আবু হাসান শাহরিয়ার) 

সাহিত্যের সমালোচনা কি আদৌ সম্ভব? নাকি অবধারিতভাবে সাহিত্যসৃষ্টির পরেই আসবে সাহিত্য জিজ্ঞাসা, যাকে বলা হবে সাহিত্য সমালোচনা? এই দুই প্রশ্নের দ্বন্দ্ব বহুকাল তাড়া করেছে সৎ সাহিত্যচর্চাকে। T.S.Eliot তাঁর "Tradition and Individual Talent " তে বলেছেন, "criticism is as inevitable as breathing",আবার জীবনানন্দ দাশ তাঁর সমালোচকদের বলেছেন, "আরূঢ় ভণিতা"...;
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন ,"...একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে",  তেমন  Flaubert তাঁর সমালোচকদের ওপর ক্রোধ উগরে দিয়ে বলেছেন, "what droll creatures these college professors are whatever they talk about art"...
কিন্তু, শিল্পের গন্তব্য যদি মানুষ হয়, মানুষের সাড়া পাওয়াটাই তো তার অস্তিত্বের ভিত্তি; এবং এইখানেই উঠে আসে প্রশ্ন, তবে কি 'সাহিত্য সমালোচনা' মানে  কেবল পুস্তক পরিচিতি?কখনো লেখাকে উচ্চ প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া,অথবা চড়াও হয়ে লেখাকে খারিজ করে দেওয়া, ―এর বাইরে সমালোচক শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের মত সততার সঙ্গে বলতে পারেন তো?

অবশ্যম্ভাবী যে প্রসঙ্গ আসবেই এরপর তা হল, সমালোচনা যিনি করবেন, তাঁর যোগ্যতা ও দায়িত্বজ্ঞান কেমন হওয়া উচিৎ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, " সাহিত্যের বিচার করিবার সময় দুইটা জিনিস দেখিতে হয়।প্রথম ,বিশ্বের উপর সাহিত্যকারের অধিকার কতখানি, দ্বিতীয়, তাহা স্থায়ী আকারে ব্যক্ত হইয়াছে কতটা।" এই বক্তব্যের অনুষঙ্গেই আসে 'সমালোচনা সাহিত্য'!

প্রকৃত সমালোচনার সংস্কৃতি যে সমাজে বিদ্যমান, সে সমাজে সৃষ্টি হয় সৃজনশীল মানুষ। এখন ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের receptive code তো একরকম নয় ,তা বহুধরণের বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।পরিবেশ, মূল্যবোধ, মানসিক গঠন বা পাঠাভ্যাসের ভিন্নতার দরুণ সমালোচনা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং, সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গেই কিছু সাহিত্যতত্ত্বও গড়ে ওঠে ,যার নিয়মগুলি প্রয়োগ করে বস্তুগতভাবে সাহিত্যের বিচার মোটামুটি সম্ভব।অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স থেকে শুরু করে এই সমালোচনা তত্ত্ব ,গত দু শতকে বিভিন্ন মতামতে ঝালাই বাছাই হয়ে ও নানান শাখা প্রশাখা অনুসরণ করে আজকের উত্তরাধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহিত্য সমালোচনার এই ধারাবাহিক ইতিহাসের কান্ডারীরা হলেন :

আদি – অ্যারিস্টটল
রেনেসাঁ― ফ্রান্সিস বেকন ও অন্যান্য
এনলাইটেনমেন্ট ― হিউম,কান্ট,মেরি উলস্টোনক্রাফট ইত্যাদি
ঊনবিংশ শতক― হেগেল,মার্ক্স, নিটসে,জন স্টুয়ার্ট মিল, টলস্তয় ও অন্যান্যরা
নব্য― ফ্রয়েড, স‍্যস‍্যুর, সার্ত্র, সিমোন দ‍্য বোভায়া, দেরিদা, ফুকো,বার্থ, লাকাঁ ,চমস্কি.....

এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে যে, বাংলা সাহিত্যের সমালোচনায় পাশ্চাত্যের তত্ত্ব কতটা যুৎসই! কিন্তু জ্ঞান বা তার পদ্ধতি তো স্থবির নয়।সাহিত্য ও দর্শন কোনোটাই বিজ্ঞানমনস্কতা না নিয়ে এগোতে পারে না।
অবশ্য এটাও ঠিক, সমালোচক যদি তত্ত্বের খাঁচায় বাস করে একদেশদর্শী হয়ে পড়েন ,তাহলে তার সমালোচনাও নিতান্ত অনুভূতিশূন্য জড় বলে বোধ হবে।তখন জীবনানন্দের ভাষায়,
" পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা,কালি আর কলমের 'পর
বসে আছে সিংহাসনে― কবি নয়, অজর, অক্ষর
অধ্যাপক...."

এইবার আমরা আসি, 'সমালোচনা সাহিত্যে'র আসল কথায়।Percy Lobbock এর কথায় "কেউ যখন একটি উপন্যাস পাঠ করেন, তখন তিনি নিজেই একজন লেখকে পরিণত হন।" অর্থাৎ, একটি উপন্যাস বা কবিতা যখন সৃষ্টি হয়, তখন তা স্রষ্টার।কিন্তু পরবর্তীতে সিরিয়াস পাঠক যখন তা নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করেন, তখন তিনি নিজেই স্রষ্টার ভূমিকা নেন , অর্থাৎ তিনি নিজে লিখলে কী পরিবর্তন করতেন তা ভাবতে পারেন।এভাবেই প্রকৃত সমালোচক সাহিত্যিকের সৃষ্টি কার্য গভীরভাবে উপলব্ধি করে ও তাঁর নিজস্ব বোধে জারিত করে যে সমালোচনা করেন, তাকেও সৃষ্টি বলা চলে ,সাহিত্যও বলা চলে।
Murray বলেছেন, "a good criticism is as much a work of art as a good poem".

বিপরীতে একজন সাহিত্যস্রষ্টার মধ্যেও কি একজন সমালোচক বাস করেন না? একজন সাহিত্যিক বা কবি ক্রমাগত তাঁর পাণ্ডুলিপি পরিমার্জিত করে চলেন, যতক্ষণ না তিনি তৃপ্ত হন। এখানে তিনিও কি একজন সমালোচকের দায়িত্ব পালন করছেন না? তাই সার্থক স্রষ্টা ও সার্থক সমালোচকের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে দূরত্ব খুবই ক্ষীণ।

আসলে প্রকৃত সাহিত্য এমন , যাতে একের ওপরে আরেক অর্থ যা আমাদের বস্তুজগত সম্পর্কে ইউক্লিডীয় ধারণাকে ভেঙে সীমাহীন অর্থে ব্যঞ্জনা এনে দেয়।এবং এই ব্যাপারে পাঠককে সাহায্য করেন একজন সমালোচক, যিনি তার নিজের সৃষ্টিশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে এক নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করেন, যার নাম 'সমালোচনা সাহিত্য'।

ঋণ : সেজান মাহমুদ
        সাহিত্য প্রকরণ



Artist - Romena Debnath 



---------------------------------------------------------------------------------


বই আলোচনা:-



শৌভিক রায়
রঙিন আগন্তুক /অন্বেষিকা দাস 


সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তরুণ কবি অন্বেষিকা দাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রঙিন আগন্তুক`। মোট তিপান্নটি কবিতা মলাটবন্দি হয়েছে চার ফর্মার এই গ্রন্থে। রায়হান শশীর প্রচ্ছদে, ঝকঝকে মুদ্রণের গ্রন্থটি প্রথম নজরেই ভাল লেগে যায়। 

অন্বেষিকা দাস বেশ কিছুদিন ধরেই কবিতা লিখছেন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়লেও, এটিই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তাঁর বেশ কিছু কবিতা সাবেকি ধারার। আবার কিছু কবিতায় ফর্ম ভাঙবার প্রবণতা দেখা গেছে। কিছু কবিতায় সাধারণ শব্দের শাণিত ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করবে। আবার কিছু কবিতা আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় অনন্য হয়ে উঠেছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে অবশ্য সেভাবে নতুন কোনও কথা বলেন নি কবি। তবে সেটি বড় ব্যাপার নয়। কেননা সে অর্থে দেখতে গেলে কেউই নতুন কিছু বলছেন না। বরং প্রয়োগের দিক থেকে অভিনবত্ব আধুনিক কবিতাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কবিতার পরিভাষা বদলে যে সৃষ্টি বর্তমানে হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতার এক অন্য যাত্রাকেই প্রমান করে। ভাবতে ভাল লাগছে যে, কবি অন্বেষিকা দাস সেই যাত্রার অন্যতম একজন শরীক। তাই হয়ত তিনি বলতে পেরেছেন, 'আজ সেই বসন্তবাউরি আমার মুঠোফোনে,/ হয়ে চলেছে ভালো-মন্দের কথোপকথনে` অথবা 'নৌকা, সে কোথায় যাবে যাক,/শুধু তুমি থেকো পাশে` কিংবা 'তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথায় বলো ওষুধ খেয়ো না /বরং বাম লাগিয়ে দেখো/রং-বেরঙের পছন্দের রান্নায় বলো/আইবিএস আছে ভুলে গেছে নাকি`।  

এরকমই আধুনিক ভাবনায় ও ভাষায় সমৃদ্ধ হয়েছে অন্বেষিকা দাসের অধিকাংশ কবিতা। তবে কিছু কবিতা ব্যক্তিগতভাবে দূর্বল মনে হয়েছে। কিছু শব্দ-চয়নও একটু সেকেলে ধরণের যেন! তবে সেটা বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে বলেই দৃঢ় বিশ্বাস। সামগ্রিকভাবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাঠে পাঠককে হতাশ হতে হয় না, বরং কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ পাঠের ইচ্ছা জেগে ওঠে। কবি ও গদ্যকার রাহেল রাজিব কাব্যগ্রন্থ নিয়ে মুখবন্ধে বলেছেন, 'আবেগ-উচ্ছাসের আড়ালে অন্বেষিকা তুলে ধরতে পেরেছেন সময় ও সম্পর্কের আয়ুরেখা।` 





কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক বাংলাদেশের কবি মানস। পরিবেশক ধানমন্ডি, ঢাকার বেঙ্গল বই। মূল্য ২০০ টাকা


--------------------------------------------------------------------------------

সুস্মিতা কৌশিকী

দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী/সুজিত অধিকারী

প্রেয়ারলাইন শেষ হলে :

   ' দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী '

কবিতা কি এক মন্ত্রপূত আরোগ্যহীন মিঠে যন্ত্রণা ?  হবে হয়তো । তা না হলে কবি কেন ফিরে ফিরে যাবেন নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে যন্ত্রণাময় আনন্দ জাগাতে । কবিতা অনেকেই লেখেন । শব্দের কারুমন্ডে গড়ে তোলেন মানস প্রতিমা, মায়া প্রকৃতির প্রান্তর , আবহমানের গায়ে লেপে দেন সুশ্রাব্য কালস্বর । কিন্তু সব কবিতা শেষ পর্যন্ত ভাষার জড়ত্ব থেকে মুক্তি পায় না।আর তাই সেই সব কবিতা অসমাপ্ত সৃষ্টির মতো স্বপ্নের রঙ বোলাতে গিয়েও মুখ থুবড়ে পড়ে । শব্দ আর শব্দোত্তর ব্যঞ্জনা , ভাব আর ভাষার মেলবন্ধন না হলে কবিতা তার অন্তরের চোরাপথ খুলে দেয়না , যে পথে  অনন্ত হেঁটে গেলেও ক্লান্তি আসেনা বরং এক পরম পাওয়ার আনন্দে মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে । অক্ষর ,শব্দ ও বাক্যবিন্যাসের যাদুতে মানুষের যাবতীয় যাপন -ভাঙনকে দূরে সরিয়ে মনকে দোলা দিয়ে যাওয়া কি সহজ কাজ ? কারো কারো কাছে হয়তো কেবল  সহজ‌ই নয় , সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত । যাঁরা মননের সাথে সাথে যাপনে , জ্ঞানের ( সংজ্ঞা ) সাথে সাথে নির্জ্ঞানেও  কবি । অকপট কথা বলেন নদীর কাছে , বিষণ্ণতার কাছে দিব্যদৃষ্টি গচ্ছিত রেখে নিজেই হয়ে ওঠেন অন্ধমুনির পুত্র আর  তারপর‌ই  বসন্তের অসফল জ্যোৎস্নায় অহরহ অন্ধকারের ব্যাকরণ ভেঙে হেঁটে যান মহাপ্রস্থানের অমেয় পথ ধরে ।
           
 কী হয় তখন ? হয়তো নিস্পলক চোখের আঙিনায়  চড়ুই পাখির মতো নেচে বেড়ায় শৈশব । কৈশোরের জল- ধোয়া সৌরভ নিয়ে জুঁই হাজির হয় আবেশিত স্বপ্নমন্ডলে আর অন্ধকারের চিরাগ থেকে অযুত জোনাকি উঠে আসে কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে : 
 
"কতবার কেঁদেছি ফুল হাতে
কতবার অস্তগামী ভাষা
জন্ম- মৃত্যুর নেশার মতো কতবার আমি ভোর

তবে ফুরিয়ে যায়নি সবকিছু
বিচ্ছেদে দু-ফোঁটা চোখের জল 
তৈরি করে অনেক প্রতিবিম্ব। "
                                 (বোহেমিয়ান )

" ভাঙা মেঘের পাশে চাঁদের মতো
সুদেষ্ণার আসা যাওয়া আজ বড় রোমান্টিক

মনে হয় তাকে কাইনেটিক্স পড়াচ্ছি । "

                                     (কাইনেটিক্স পড়াচ্ছি )

এ যাবৎ সুজিত অধিকারীর দুটি ব‌ই 'ডাউন ট্রেনের কামরায় 'ও ' মনখারাপের অনুচ্ছেদ ' --এ  কবিতার জগৎ ছিল  ধ্যানমগ্ন নৈঃশব্দের শব্দায়ণ  । বিষণ্ণতার চাদরে ঢাকা গূঢ় সংকেতময় তাঁর কবিতা- উপলব্ধি অবশ্যই জীবনবোধের অনুকম্পায় একনিষ্ঠ।

           এবারে কবির  ' দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী ' এক ভিন্নতর ও বৈচিত্র্যময় কাব্য অভিজ্ঞতা । মনে হয়  দীর্ঘ ধ্যানলিপ্ত মানুষ ধ্যানভঙ্গের বিস্ময় নিয়ে চেয়ে দেখছেন পৃথিবীর রূপ রস গন্ধময়তা ,  ধোঁয়া ধুলো কাদা  ,কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির বাস্তবতা ,ষড়যন্ত্র , মানুষের অসহায়তা।

 "তারপর রত্নাকরের মতো মরা মরা করতে করতে 
একদিন উইঢিপি থেকে মাথা তুলে দেখি
তোমার চোখে ইন্দ্রজাল 

এই তো রামনাম পেয়ে গেলাম

শুরু হল বীজমন্ত্র , রাতে ঘুম নেই
বুকে হানে তীব্র দহন

ঋতুর মতো ফিরে ফিরে আসে সেই ইষ্টনাম
তবু তোমার প্রতি অ্যাটেনশন ইষ্টনামের চেয়েও প্রিয় ।"

                                                  (  অ্যাটেনশন )
" আমার বোনের মতো কাঁদছ , কেঁদে নাও
মায়ার পরে কী আছে আচ্ছন্ন ,
প্রিয়দার মতো কোমায় কী আছে জীবন

বাইরে পাখির উড়ান , সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা

আমাদের ঘর কোথায় ? "

----স্মার্ট শব্দের ব্যবহার , সগর্ব উচ্চারণ ,  সমকালীনতা  , আঞ্চলিক উপস্থাপন,  পরিপক্ক জীবনবোধের বৃত্তান্ত ব‌ইটিকে কবির পূর্বতন ব‌ইগুলি থেকে এবং সমসাময়িক কবিদের লেখা থেকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

          ' দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী ' কবির প্রস্থুমাস কাব্যগ্রন্থ। বড় অকালে চলে যাওয়া,  কবিতায় তীব্র তরুণ ও পাঠক- প্রিয় কবি সুজিত অধিকারীর এই বইতে যে বৈশিষ্ট্যাবলী পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে তার প্রথমেই বলা যায় বহুসংখ্যক নারী - নাম । সুদেষ্ণা ,  মোনালিসা , পারমিতা , নন্দিনী, নীলাঞ্জনা , চামেলী , তমালিকা,  শ্রীলেখা , চন্দ্রা ,দেবারতি, কাবেরী ,  কঙ্কনা--  জীবনানন্দের কবিতা ছাড়া এতো নারীনাম বাংলার আর কোন কবির কলম থেকে ঝরে পড়েছে ? আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীরা '-র  মতো এক নামে একাধিক কবিতার সমাহার‌ও লক্ষ্যনীয় । এঁরা কারা ? সকলেই কি কবির মানসী -কন্যা , নাকি কেউ কেউ রক্ত - মাংসের আদলে ---সে উত্তর আর কোনো দিন‌ই পাওয়া যাবে না । তবে এই নারীরা প্রত্যেকেই প্রেমময়ী নয় বরং বৈচিত্রময়ী । এদের মধ্যেও শেক্সপিয়ারের 'ডার্ক লেডি ' এর মতো প্রেমহীন নারীও রয়েছে। তবে প্রতিটি উল্লেখ‌ই এতো আন্তরিক যে কবিতার পংক্তি ছেড়ে তারা যাপনের সম্পৃক্ততায় উঠে এসেছে । যেমন  আরো বেশ কিছু নাম বা সম্পর্কনাম  আছে যেগুলির উল্লেখ কবির আন্তরিক যাপনের‌ই ইঙ্গিতবাহী । যেমন ---  নমিতাদি , দুর্গাদিদি, যতীনবাবু, বিন্দি পিসি , মেজো বৌদি  এই সব নাম গুলো , সম্পর্ক গুলো আসলে জীবনের প্রতি ,  ,সম্পর্কের প্রতি কবির  আর্তির প্রকাশক , নিঃসঙ্গতা ভেঙে ফিরে যাবার আন্তরিক চেষ্টায় কবি যেন একটি রক্তাক্ত গোলাপ  । কিন্তু মানুষ কতটা ফিরতে পারে বৃত্তের বাইরে একবার পা বাড়ালে ? -- এই অমোঘ প্রশ্ন বিদেহী আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায় কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায়।
            কবির আঞ্চলিক উপস্থাপন ইঙ্গিত করে যে তিনি জীবনকে কেবল অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই উপলব্ধি করেননি , খোলা রেখেছিলেন তাঁর বাইরের দুটি চোখ‌ও ।  চেয়ে দেখেছেন তাঁর পরিমন্ডল , পর্যবেক্ষণ করেছেন , বিচার - বিশ্লেষণ করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ আর এ বিষয়ে সহায়ক হয়েছে তাঁর মেধা । সেই জন্য বিনির্মাণ  তাঁর কবিতার আবশ্যিক ভাবে ফিরে ফিরে এসেছে :

"জলহস্তিসহ তিনটি পশুকে ভয় পেয়েছিলেন
শেষ সুযোগে সাপের লেজ ভয়ে ভয়ে ছুঁয়ে আপনি
এক যুগের রাজা হলেন
ইতিহাস উঁচু ঢিবি হয়ে সাক্ষ্য বহন করে গড়ের মাঠে

সাপুরিয়া তো কত সাপের লেজ ধরে ,মাথা ধরে
বাড়ি বাড়ি খেলা দেখায় , কত কসরৎ
ইতিহাস তখন কথা বলে না

আসলে রাজভাগ্য সবার জন্য নয়
ঠিক যেমন কবির ভাগ্যে প্রকৃত প্রেম জোটে না । "

                                           (কামতেশ্বর )

       ‌‌ ‌‌      কবি এক অভিজ্ঞ ভ্রামনিক । জীবনের পথে তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এক দ্রষ্টার , এক প্রাজ্ঞ দার্শনিকের ।
" আমি তো অনন্ত পথিক গাছের নীচে / ঘুরঘুর করে দেখি প্রতিবিম্ব মানুষের " -- এই দীপ্ত উচ্চারণের সঙ্গেই মিশে রয়েছে এক অপার  অসহায়তা-- " হাত বাড়াও , আমিও যাই / কে যেন আমাদের রক্তে মিশিয়েছে মায়ান্ধ চোখ ।" এখানেই কবির স্বরধ্বনি মানুষের কলকন্ঠ হয়ে ঘোষণা করে ' আমি তোমাদের‌ই লোক '।
কিন্তু এই দেখার‌ই বা শেষ কোথায় ? দিনের শেষে অনুভূতিপ্রবণ মানুষ কোথাও কি আশ্রয় পায় ? কে তাকে দেয় হিরণ্য আঁচলের ছায়া ? মানুষ কতটুকু  পারে অন্য  মানুষের আদর্শ সহচর হতে ,  যে নিজেই অসহায় , একা বা একাকী আত্মহারা । কবিতা ছাড়া আর কে থাকে তখন ! তাই এই চলার ইতিহাস অতিক্রম করে মানুষ বেছে নেয় নিজের সেই গন্তব্য , যেখানে কালের লেখনীতে খোদাই হয় মুক্তির কৃষ্ণলিপি , সাদা কবুতর ডানা মেলে উড়ে যায় ঐশী বিভায় । আর কবিতার শরীরে জেগে ওঠে সেই নীল বিষণ্ণতার নষ্টালজিক জন্ম জড়ুল ।

" এ মুখ লুকাই কোথায়
এতো মিথ্যাচার 
এর নাম যদি দেশপ্রেম হয় ...

কার কাছে যাই
যার কাছে যাই
তার‌ও হাসির ব্যাকফুটে রয়েছে শেয়ালের চোখ "

সুজিত অধিকারীর কবিতা যেন কবির নিজের  মনের ভাঙা আয়না । যার প্রতি টুকরোয় ভেসে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবিম্ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো অস্বচ্ছতার বাতাবরণ তৈরি করেননি  তিনি , রাখেননি এতটুকু বিরুদ্ধ  অভিযোগ‌ও । কেবল নিজের অগম্য অক্ষমতার ধূসর যাপনকেই উজ্জ্বল আখরে বেঁধে ছেড়ে দিয়েছেন মহাশূন্যে  ' আমি তো গাছের মতো নিরুপায় / আকাশে কোনো  মেঘ নেই '। তাঁর ধ্বনি- অক্ষর - শব্দ - চিত্রকল্প কোন এক অমোঘ টানে যেন আমাদের পরিক্রমা করে চলে নিয়ত , নাকি আমরাই প্রদক্ষিন করছি তাঁর কাব্যমন্ডল --- কে জানে ! বিংশ‌ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও ক্রিটিক টি . এস . এলিয়ট যেমন বলেছেন‌ -- It is a test ( that ) genuine poetry can communicate before it is understood ,' দীর্ঘ ভাঙনের পর আমি আর নদী ' কাব্যগ্রন্থটি এই মাত্রায় একটি সার্থক উত্তরণ । কবিতাগুলো বোধগম্যতার তল খুঁজে পাবার অনেক আগেই হৃদয়ের উষ্ণ স্তর ছুঁয়ে ফেলে। তাই পাঠ‌-উত্তর  অনুভবে উঠে আসে এক অনন্য অনুভূতি--

সুদূর আকাশে উড়ে গেছে শঙ্খচিল। তার ডানার লবণ ঘ্রাণ এখনো  ছড়িয়ে ....



  --------------------------------------------------------------------------    

কবিতা:-


দুটি কবিতা

পঙ্কজ ঘোষ

          
                ( ১ )

ছেলেবেলায় শুনতাম 
       বোবার কোনো শত্রু নেই।
তখন বারবার প্রার্থনা করত
ঠাকুর, জন্মান্তরে আমি যেন অজাতশত্রু হই

এখন চারিদিকে
এত কথা না - বলা মানুষ দেখে দেখে
বুঝেছি, বোবার চেয়ে বড়ো খুনি ও আততায়ী
আর একটিও নেই।

                ( ২ )

সমস্ত কথারা একদিন মরে যায় --
একথা বুঝিনা বলেই
জীবন মাটি থেকে মঞ্চে উঠে যায়
আর প্রতিদিন নিখুঁত অভিনেতা হয়ে উঠতে থাকি।
দ্যাখো, কীভাবে ছায়ার থেকে
         নিজেকে লুকিয়ে রাখছি
আর স্বপ্নের ভেতর
    ঘুমগুলো আত্মহত্যা করতে থাকে রোজ।



---------------------------------------------------------------------------------
দুটি কবিতা

সুফল সান্যাল


১.

ডিটেনশন ক্যাম্প বানানো বাজে কেন!

সেখানে উইপোকারা থাকে।

বলছি শুনুন, গ্যাস চেম্বারই আসলে সবার জন্য ভালো। 

২.

অন্ধকারে শুয়ে-বসে 
মশার কামড়ে বাঁড়া 
ফুলে ফুলে গুটলি পাকিয়ে গেছে
 
সিন্থেটিক আলোতে শুনেছি 
পোকামাকড় 
অন্ধ হয়ে যায়!

৩.

তবে কি জানেন, 
ম্যানহোলের ভিতর 
দুর্গন্ধভরা জলে, 
আরশোলা দেখতে পেলে 
আমি নিশ্চিন্ত হই

৪.

যারা এখনও মনে করে,

"লকডাউন করতেই হত, কিছু করার ছিলনা।"

আমি চাই, তাদের সম্পত্তি লুঠ করা হোক
শব্দগুলোর তীক্ষ্ণ বুলেট 
তাদের গায়েও লাগুক,

"সত্যিই শালা, কিছু করার ছিলনা।" 

৫.

সেদিন এক আমেরিকান দার্শনিকের মুখে শুনেছিলাম ক্যাপিটালিজম ওয়েলথ প্রোডিউস করে... আর কমিউনিস্টরা প্রোডিউস করে ভায়োলেন্স। তাই আমি আধা অর্ধমনস্ক কমিউনিস্ট এখানে প্ল্যান্ড ভায়োলেন্স চালাচ্ছি...

"এসব চক্রান্ত রুখে দিন। ধম্মের পথে আসুন।"

৬.

ধ্বংস
কতটা 
প্রয়োজনীয়? 

আসলে সবাই
অ্যাফোর্ড করতে পারে না 
প্রিসিশন টেকনিক...
যদিও এখনও সে বোঝেনা, 
সে আসলে কতটা হিপোক্রিট!



শকুনি 


দুর্ধর্ষহিম বালিয়াড়ির ওপর, মন্বন্তরের শিশু, শীর্ণ হাত-পা পাঁজর ঠেলে বেরিয়ে আসছে, কৃষ্ণাঙ্গ শিশুটি মৃত্যু পর্যন্ত ঝিমোচ্ছে। খানিক ডিস্টেন্সে, শিশুটির হার্টবিট লক্ষ্য করছে এক শকুন ঘাপটি মেরে... আহ্, অ্যাবসোলুট আর্ট! উচ্ছাসে লাফিয়ে উঠলো ঘুঘু ফোটোগ্রাফার। ছবি তুলে, আত্মতৃপ্তির মৃদু ঢেকুর, ফ্লাইট উড়ে গেল নিজের ডেস্টিনেশন। মন্বন্তরের শব্দ, দ্রিমদ্রিম অথবা শাদাকালো পিয়ানোর দুখুদুখু সুরে, বাজলো শকুনির কানে। রন্ধনশালার দিকে চোখ রেখে একপায়ে বসে রইলো, আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো চুল্লির আঁচ নিভে যাবে।
---------------------------------------------------------------------------------
Artist - Bishwajeet Ray 

-------------------------------------------------------------------

বই আলোচনা:- 


সুবীর সরকার 
মুসলমানমঙ্গলঃএক বেদনার উপাখ্যান


জাকির তালুকদার।বাংলাদেশের নাগরিক,বাংলা গদ্যের শক্তিশালী ও সময়সচেতন এক ব্যক্তিত্ব।জাকিরের লেখার আমি মুগ্ধ পাঠক।জনমানুষের যাপন ও জীবনযাপনের সংকট তার লেখায় নিখুত উঠে আসে।সমাজবিজ্ঞানের নিম্নবর্গীয় ইতিহাসসুত্রের জাল ও জালকের ভেতর দিয়ে জাকির তার দেখাকে জায়মান এক বিস্তারের দিকে ছড়িয়ে দিতে জানেন।এখানেই তার মুন্সিয়ানা।তার নানান ছোট গল্পে,উপন্যাস ‘পিতৃগণ’, ‘কুরসিনামা’, ‘কবি ও কামিনী’-তে জাকির আবহমান মানুষ ও তার জীবনযাপনের পরম্পরাকে জীবনের মহার্ঘ্যতাতেই চিরকালীন করে তুলতে পেরেছেন।তার চরিত্রগুলি যেন আমাদের চিরচেনা দুনিয়াদারির ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় গান গাইতে গাইতেই।

সম্প্রতি পড়ে ফেললাম জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’.২০১৫ তে আমার বাংলাদেশ ভ্রমণকালে নাটোর শহরে জাকির নিজেই তার এই বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।তারপরে ২ বার আমাকে এই বইটি পাঠ করতে হয়েছে।এই অনবদ্য পুস্তককে কি বলা যায়!উপন্যাস?আখ্যান?না কি কাহিনিকল্প?জানি না,তবে একথা বলতে পারি চলতি পথের থেকে ঢের দূরে এই বইটির অবস্থান।ধরে নিচ্ছি এতা উপাখ্যান।চ্যালেঞ্জিং এই লেখাটায় জাকির আবহমানের সময়সমাজকালক্রমকে নিখুত কাঁটাছেড়া করেছেন।তুলে এনেছেন সংকট ও সময়ের গর্তে ডুবে থাকা অসুখগুলিকে।

মৌলবাদ,বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়,ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস,মুসলমানদের রক্তাক্ত বেদনার কথা,অন্ধকারের চাদরের নিচে ঢেকে রাখা কুসংস্কার,ইসলামের গৌরব ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস,ধর্মযুদ্ধ,এবং উত্তরণের পথ খুঁজতে বেরিয়ে পড়া মুক্তচিন্তার কতিপয় যুবকবৃন্দ-সব মিলিয়ে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে জাকির বুনতে চেয়েছেন তার ‘মুসলমানমঙ্গল’।

উপাখ্যানের শুরু হয় মুখ্য চরিত্র ইউজেফ আমেদ যাকে ইউসুফ নামেই আমরা পরিচিত দেখি,সেই ইউসুফের চলনবিল অঞ্চলে তার দিদির বাসায় যাবার দৃশ্য দিয়ে।সে তার আপার বাসায় গিয়ে চলনবিলের সাধারন মানুষের জীবনযাপনকে খুব নিবিড়ভাবে দেখতে থাকলো।সে দেখলো ইসলামের কড়া বিধিনিয়মে বাঁধা মানুষের জীবন।তার দুলাভাই ধর্মীয় মুরুব্বী সেখানে।পাশপাশী চরম অভাব,দারিদ্র,সংস্কারের ভারে চাপা পড়া একটা সমাজজীবন।মাদ্রাসা শিক্ষা বহুল চল।আধুনিক শিক্ষার সেখানে অভাব।এসব তাকে তাড়িত ও চিন্তিত করে তুললো।জাতির ভবিষ্যত ভেবে তার বিষাদ ভারি হয়ে উঠলো।ইউসুফ তার দুলাভাইএর সাথে ইসলামের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ও বাহাসে লিপ্ত হল।তখন রোজার মাস চলছে।ইসলামের ইতিহাসের কথা উপন্যাস জুড়ে জাকির তুলে ধরেছেন।অতীত থেকে সমকালে ইসলামের খঁটি ও মেকি দিকগুলি আখ্যানে নানাভাবেই এসেছে।ইসলাম প্রতিঠার পর্ব,পর্বান্তর,স্বর্ণযুগ,অন্ধকার সময়,খলিফা পদের দখলদারির লড়াইকেও আখানের ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে দেওয়া হয়েছে বারবার।

ইউসুফ মুক্তচিন্তার,মুক্তমনা এক ব্যক্তিত্ব।সে চায় সুন্দর এক সমাজ গড়ে উঠুক।বাইরের চাপে পিষ্ট হওয়া বাঙালি মুসলমান সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোকময়তায় পৌঁছে দেবার পথ খোঁজাই তাই ব্রত হয়ে দাঁড়ায়।মাদ্রাসার আব্দুল খালেক ও তার দুলাভাইএর সাথে সে লিপ্ত হয়ে পরে নানান আলাপচারিতায়।হজরত মুহম্মদ থেকে শুরু করে ইসলামের নানান বাঁকগুলি,ইতিহাসগুলি জাকির এই উপাখ্যানে ধারাবাহিকভাবেই তুলে এনেছেন বারবার।ইসলামের নানান আন্দোলন, ওয়াহাবী,ফরাজী,খেলাফত,বাংলায় ইসলামের বিস্তার,মক্কা-মদিনা-আরব থেকে সারা দুনিয়ায় ইসলামের চলাচলকে নিখুঁতভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে বারংবার।

ইসলাম শান্তি,সাম্য ও মানবতার এক মানবধর্ম।কিন্তু কাঠমোল্লা ও ধর্মব্যাবসার জন্য,ইসলামের অপব্যাখ্যার জন্য আজ ইসলাম সন্দেহের চোখে,যা ইউসুফকে তীব্র ব্যাথিত করে তোলে।মৌলবাদ ক্রুদ্ধ করে।সে পরিত্রানের পথ খুঁজতে থাকে।আব্দুল খালেক কে সে বলে-‘একসময় মুসলমানরাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উদার এবং যুক্তিপ্রিয় জাতি’।ইউসুফের উপলব্ধি-‘অসহিষ্ণুতা আর পিছিয়ে পড়া,এই দু’টি জিনিষ একটা আরেকটার সঙ্গে সঙ্গে চলে।যতদিন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান,চিন্তা-চেতনায় যুক্তির চর্চা করেছে, ততদিন তারা পৃথিবী শাসন করেছে।যখন বিজ্ঞানচিন্তা ত্যাগ করে গোঁড়ামিতে ফিরে গেছে,তখন থেকে তার পতন শুরু।সেই পতনের ধারা এখনও অব্যহত।কবে যে থামবে সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না’।ইউসুফ আরো বলে-‘মুসলমাদের মধ্যে যুক্তিবাদী অনেক গোষ্ঠী ছিল।মনে রাখতে হবে,যুক্তিবাদী হলেই তাকে ধর্মবিরোধী হতে হবে,এই ধারণা ভুল’।

আপার বাড়ি থেকে একসময় ইউসুফকে চলে আসতে হয় ঢাকায়।সেখানে তার মুক্তমনা কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছে।যাদেরকে জড়িয়ে নিয়েই সে স্বপ্ন দেখে এক উন্নতততম ও আধুনিক মানবজীবনের।ধর্মীয় রীতিনিয়মের অনুশাসন অনুসরণ করেই তারা সংস্কারমুক্ত এক মানবধর্মে রুপান্তরিত করতে চায় ইসলামকে।দেশ কাল সময় সমাজের বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।এই উপমহাদেশের রাজনীতি ,ইসলাম ও অন্য ধর্মের বিস্তারের বিষয় নিয়ে তারা নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকে।মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের নানান সময়ের অবস্থান,মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা,

দেশভাগের প্রেক্ষিত,জিন্না-নেহেরু,সাম্প্রদায়িকতা,উপমহাদেশের উত্তাল হয়ে ওঠা রাজনীতি কাঁটাছেঁড়া করতে করতে ইউসুফেরা বেশ বুঝতে পারে সংকটের শেকড় কোথায়!মৌলবাদের বীজ কোথায়।অশিক্ষা,ইংরেজী ও বিজ্ঞান চিন্তার অভাব আর মাদ্রাসার বাড়বাড়ন্তের ফলে মুসলিম সমাজ সারা বিশ্বের মুল স্রোত থেকে কত পিছিয়ে পড়েছে।

‘মৌলবাদের একটি প্রধান লক্ষণ হচ্ছে,ক্ষমতা দখলের লড়াইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে সংখ্যালঘু  বা দূর্বল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা’।–বন্ধু ধীমান উপমহাদেশের হিন্দু আগ্রাসনের রাজনীতি,বিজেপির উত্থান এর পাশাপাশী বাংলাদেশে জামাতের রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ কথালাপ চালিয়ে যায়।একসময় ধীমান থামে।চায়ের কাপে চুমুক দেয়।আর ইউসুফ বলে ওঠে-‘এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কটি সবসময়ই ক্রিটিক্যালি পর্যালোচনা করা উচিত’।আবার ‘এতে লাভ কি’?সাদী ওস্তাদের প্রশ্নের জবাবে ইউসুফ জানায়-‘ইতিহাসের দায়মুক্তি’।

ইউসুফের প্রেমিকা উপমার কথা আসে।উপমা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে কলকাতায়।সে কি আর ফিরে আসবে।ইউসুফের লড়াই আর সমস্ত স্বপ্নের পাশে পাশে উপমাই শেষাবোধী থেকেই যাবে হয়তো।হরিপদ দত্তর প্রসঙ্গ আসে।

আব্দুল খালেকের এক প্রশ্নের জবাবে ইউসুফ বলেছিলো-‘আমাদের মোল্লা-মোলানারা অশিক্ষিত বটে,কিন্তু নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ষোলআনা বোঝে।তার ওপর তাদের পরিচালনা করে,যারা ইসলাম বিক্রি করে আমাদের দেশে রাজনীতি করে,সেই ধুরন্ধর লোকগুলো।আপনি এমন কাজ করতে গেলেই ওরা আগে আপনাকে ঘষণা করবে মুরতাদ।তারপর মসজিদে মসজিদে প্রচার করবে যে অমুক লোকটা ইসলাম বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে,মুসলমানদের ক্ষতি করছে।আমাদের দেশের অশিক্ষিত মানুষের জন্য এটুকুই যঠেষ্ট’।এটা শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রে নয়,সারা দুনিয়ার সকল ধর্মীয় মৌলবাদের একই চেহারা ও চরিত্র।এ এক গভীরতর অসুখ।ইউসুফ আরো শোনায় মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে প্রথম সেই যুদ্ধের কথা,হজরত আলি ও হজরত আয়েশার মধ্যে।জামালের যুদ্ধ।ইহুদী-খ্রীষ্টান-ইসলামের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে কথা বলতে বলতে তার মনে পরে যতীন সরকারের কথা।

উপাখ্যানের শেষ প্রান্তে ইউসুফের সঙ্গে দেখা করতে আসে আমেরিকা থেকে গবেষণা করতে আসা তরুণী লিসবেথ,যে ১৪ মাস ধরে বাংলাদেশে রয়েছে।ইউসুফের কাছে লিসবেথ বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস জানতে চায়।এইভাবে লিসবেথ আর ইউসুফ এক নুতন জার্নির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।ইউসুফ লিসবেথকে জানিয়ে দেয়,তাদের কাজ হল-‘এ টোটাল জার্নি ইস ইসলামিক থিয়োলজি,এণ্ড ইসলামিক হিস্ট্রি,এণ্ড ইসলাম রিলেটেড এন ওর অল সাবজেক্টস মিলে আমাদের ইসলামোলজি’।লিসবেথ এর সাথে নানান কথায় ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আমেরিকার ধারনা,পাশ্চাত্যের ভূমিকা কি-উঠে আসে।লিসবেথ ইউসুফের পরিবারের সান্নিধ্যে চিরকালীন এক বাংলাদেশের হৃদয়ের মরমী ছোঁয়ায় উষ্ণ হতে থাকে।লিসবেথ পর্ব উপাখ্যানের এক জোড়ালো পর্ব।লিসবেথ হয়তো জড়িয়েই পরে ইউসুফের জীবনের অন্দরে কন্দরে!

একেবারে শেষে আমরা দেখি লম্পট,দালাল,ভোগবাদে ডুবে থাকা শামসুল কে।যে শামসুলের সাথে বচসা,হাতাহাতিতে জড়িয়ে পরে ইউসুফ।আর শামসুল তার কুটিলতাকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে পুরো ঘটনাকে ঘুরিয়ে দেয় অন্য খাতে।ইসলাম বিপন্ন। ইসলামকে অবমাননা করেছে নাস্তিক ইউসুফ। কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে মিছিল বের হয়।এক পর্বে বিচারসভা বসানো হয় ইউসুফের।বিচারসভায় হাজির থাকে রাজাকার,স্মাগলার,লম্পট ও মাতাল।বিচারসভায় বসে ইউসুফ দেখে-‘আর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে যে শত শত মানুষগুলো,তারা কারা?এদেরই ভাড়া করা মানুষ।এরা যা বলবে ইসলামের নামে সেই কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।সমাবেশের দিকে বিতৃষ্ণ চোখে তাকালো ইউসুফ।চিন্তাশীলতার কোন চিহ্ন নেই কারও চেহারায়।এরা যদি শামসুলের মতো মানুষদের কথায় না নাচত,তাহলে এই দেশটা কী এতটা নীচে নেমে যেতে পারতো!

চোখ বন্ধ করলো ইউসুফ।নিজের কী হবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয় সে।তবুও নিঃশব্দ প্রার্থনায় নড়ে উঠলো তার ঠোঁট-আল্লাহ ইসলামকে তুমি বাঁচাও’!

জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’ পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই।এই বই,সারা বিশ্বের মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইএর অনন্য এক হাতিয়ার।এক নুতনতর অভিযাত্রাও বটে।

 

মুসলমানমঙ্গলঃজাকির তালুকদার রোদেলা প্রকাশনী ঢাকা-১১০০
প্রথম প্রকাশঃএকুশে বইমেলা-২০০৯
প্রচ্ছদঃমাহবুব কামরান,মূল্যঃতিনশো পঞ্চাশ টাকা মাত্র

বিঃদ্রঃ- 
উল্লেখিত আলোচনাটি  'শব্দ বাউল' ওয়েবজিনে 
পূর্ব প্রকাশিত 




------------------------------------------------------------------------------------

প্রবীর মজুমদার
সুকান্ত সিংহ' র 'অনুপম শোনো' : এক অনুপম গদ্যগ্রন্থ 


সুকান্ত সিংহ মূলত কবি।তাই বোধ হয় লিখতে পারেন 'অনুপম,শোনো' এর মতো অপূর্ব এক গদ্যগ্রন্থ। উৎসর্গটি ও চমৎকার---'এই  জলকাদাঘুমদেশে চলো/মাদলের শব্দ হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচি'।তিনি এমন এক জগতের কথা বলেন, আবিষ্কার করেন যা আসলে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে হয়,বুঝে নিতে হয়।এক ঘোরের ভিতর তিনি লিখে গেছেন যা পাঠককেও লেখকের স্বপ্ন-বাস্তব মেশা দৃশ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়,কল্পবিশ্বের ভিতর হাঁটতে শেখায়।যেভাবে আকাশ মুখ ভার করে থাকলে তিনি বুঝে নিতে পারেন এতো অভিমানের নিজস্ব এক মাত্রা।আর তা যখন নিজেকে মুক্ত করার জন্য বৃষ্টি হয়ে ঝরে তখন তাঁর মনে হয় ---"তোমার টবে লাগানো সেই কবেকার রঙ্গন পাতা কয়েকবিন্দু অভিমান ধরে রেখেছে,তুমি দেখবে বলেই"।যেন তিনি উৎকর্ণ হয়ে থাকেন শিশির পতনের শব্দ শুনবেন বলে।তাই তিনিই লিখতে পারেন ---"সবাই কি চিৎকার করে জানান দিতে পারে?উপস্থিতি বুঝে নিতে হয়।যারা কখনও বলে না,তাদের না-বলাটুকু বুঝে নিতে হয়।মৌনতার যে নিজস্ব ভাষা আছে তা পড়ে নিতে হয়"।

যেন স্মৃতি থেকে সুকান্ত সিংহ  তুলে আনছেন সুধাভাণ্ড।এত ভানহীন! যেকোনো পাঠক পড়তে গিয়েই বুঝবেন যেন তাঁর ভিতরের আধো ঘুম আধো জাগরণে থাকা সত্তাটি জেগে উঠছে ক্রমে।যেন এভাবেই নরম সুরে আমাদের ভিতরকে স্পর্শ করছে তাঁর গদ্য।অনুপম নামের কাউকে লেখা এক পত্র জীবনী---যা জীবন রসে টইটুম্বুর।গদ্য ও পদ্যের  সীমাকে অতিক্রম করে চলে অনবরত।এত মোলায়েম তাঁর স্মৃতিমেদুর বর্ণনা ;যেন নিজেকে বারবার হারাতে-হারাতে খুঁজে আনছেন।এত এত সাধারণ, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় উঠে আসে যে পড়তে-পড়তে বিস্ময় জাগে।কোথাও যেমন আছে প্লাবনের কথা,সেই সময়ের বিপন্নতা তথা সেইসব হারানো মানুষ ---"আমাদের মাটির ঘরও ধসে পড়েছিল।জল সরলে কোনওরকমে কাঠ দড়ি টালি দিয়ে আস্তানা বানানো হয়।সেও কম বছর হল না।যারা সে ঘর বানাতে মাটি কুপিয়েছিল,বাঁশ কেটেছিল,দড়ি ধরেছিল,তারা আর নেই।গুলপেরেকে মরচে ধরেছে। দরজা আর্তনাদ করে"।সুকান্ত সিংহ স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে  একে একে আমাদের উপহার দিতে থাকেন আশ্চর্য সব দৃশ্যকল্প।টুপ টুপ করে গদ্যকারের অন্তর থেকে ঝরে পড়ছে স্মৃতি। ট্রেনে চেপে দূরে গেলে তার ধাতব চলার শব্দ যেমন ঘোরের মতো ঘোরে চারপাশে, ঠিক তেমনই যেন স্বপ্নের মানুষেরা, গাছপালা, ঘরবাড়ি সাদা-কালো ছবির মতো তাঁর চারপাশে ঘোরাফেরা করে।আর তিনি সেখানে সংলাপ বসিয়ে দেন প্রয়োজনমতো।কোথাও যেমন তিনি কল্পনা করেন 'অসনবনি' নামের স্টেশনে নেমে চায়ের দোকান খুঁজলে সেখানে একজন ট্রাক ড্রাইভার দু-গেলাস মালাই চায়ের জন্য হাঁক দেবে।আর তারপরেই ঠিক যেন সিনেমার মতো ট্রাক-ড্রাইভার আর খালাসি নেমে এলে তাঁকে দেখে বলবে,-'নমস্তে বাবুজি'।তখনই উঠে দাঁড়িয়ে দোকানের পয়সা মিটিয়ে তিনি বলবেন 'ভাল হোক'।অথচ তিনি অনেকদিনই যাননি অসনবনি নামের স্টেশনে। এক এক মানস ভ্রমণ ও বটে।আসলে সুকান্ত সিংহ তো কবি।নিজেকে অনবরত খুঁড়ে চলার প্রয়াস যেমন আছে তাঁর তেমনি অতৃপ্তিও।তাই যেন তিনি বুঝতে পারেন--"আমার ঘরের পিছন দিকে কোনও জলপ্রপাত নেই।অথচ আমি বেশ বুঝতে পারি, থাকা উচিত ছিল"।এ শুধু কল্পনা নয়।কবির মনের প্রতিচ্ছবি।যেন জলপ্রপাতের শীতল ধারায় তিনি শান্ত হতে চান।আবার কখনও স্বপ্নে কোন জলযানে উঠে আসে কোন বউ।ঘুমের ভিতর কোন এক অজানা প্রদেশে ও পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে থাকে।স্বপ্নের ভিতর তাই কারো বামহাতে দেখেন নোঙ্গরের উল্কি।শেষ অবধি মনে হয় এই অনুপম যেন তাঁর ভিতরের ঘুমিয়ে থাকা সত্তা--যাঁর সুপ্ত বাসনার কথাই  যেন তিনি বলতে চেয়েছেন।যেন নিজের ভিতরের আলোকে স্পর্শ করার অভিপ্রায়েই, পরমকে জাগানোর জন্যেই এতকিছু। তিনি ভাবতে থাকেন--"একদিন ঘুমের ওষুধ থেকে জেগে উঠবে জলপ্রপাত। অবহেলা স্নান সারবে।বেলুনওয়ালার যাওয়া ধরে রাখবে বৃষ্টিভেজা মোরামের পথ।বোতাম কুড়িয়ে দেবে রাতজাগা ট্রাকের ড্রাইভার"।

আমরা,পাঠকেরা মুগ্ধ হই,হতেই থাকি...



-----------------------------------------------------------------------

শ্যামলী সেনগুপ্ত

শ্যাস দিনে হরি বিনে নাহি পারাপার

                            
       পাটের কাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রোল খোলে।একেকটি পর্যায়ের ছবি দেখিয়ে গেয়ে যায় তার প্রাসঙ্গিক বিবরণ।শেষে চক্ষুদান।
     পট আঁকে ওরা।ওটাই তাদের রুজিরোজগারের পন্থা।বংশপরম্পরায় ওরা পটুয়া।তবে এদের বৈশিষ্ট্য, পটচিত্রে এরা আঁকে যমরাজকে,মৃত্যুর দেবতাকে।
কোনো বাড়িতে কেউ মারা গেলে এই পাটক্যাররা পৌঁছে যায় সেখানে,পেতে বসে যমরাজের পট। মৃত ব্যক্তির ছবি এঁকে চক্ষুদান করে,নয়তো পরজন্মে সে কানা হয়ে জন্মাবে। তারপর গৃহস্থ বাড়ির ভেতর থেকে আসে একটি বড় কাঁসার থালে হলুদ গোলা জল,হরিতকি,ধান-দূর্বা।আর একটি কাপড়।থালার হলুদ জলের মধ্যে পটটি বিসর্জন দেওয়া হয় মৃতের আত্মার সদ্গতি কল্পে।মৃতের পাপস্খালন হয়,তাকে আর নরকে যেতে হয় না। পরজন্মে সে চক্ষুষ্মান হয়ে জন্মায়। কাঁসার থালাটি পাটক্যারের উপার্জন।চক্ষুদান করলে দান দিতে হয়। একুশ পুয়া চাল,একটা কাঁসার থালা,তা বাদে দক্ষিণার টাকা।
     এ পাটক্যারদের জীবন নিয়েই মণিশংকরের উপন্যাস 'লালডুংরির কোল'।
লালডুংরি মালভূমি অঞ্চল।তবে ডুংরি বলতে যে ছোটখাটো পাহাড় বা টিলাকে বোঝায়,এটি তা নয়। আদ্যিকালের বিস্তীর্ণ উচ্চভূমি ধর্ষিতা নারীর মতো পিঠ উলটে পড়ে আছে।কল্লাচ তুলে নিয়ে যাওয়ায় তার গা-গতরের কোঁদর দগদগ করছে ধর্ষণ চিহ্নের মতো।বৃষ্টি ঠিকঠাক হলে ডুংরি বেয়ে লাল জলের ঢল নামে।এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠে বেড়াকলমির ঝোপ।তবে জল দাঁড়ায় না,কোথায় যে গড়িয়ে যায় তার হদিশ পায় না কেউ।এই ডুংরিতেই এসে গেড়ে বসে এক কম্পানি,শ্যালো বসিয়ে টাঁড়ভূমির গভীরে অনন্ত শয়ানে থাকা নারায়ণের ঘুম ভাঙায়,জল তুলে বোতলবন্দি করে। স্থানীয় লোকেরা সেখানে চাকরি পায়। একদিন শেষ হয়ে যায় ভূ-গর্ভের জল।কম্পানি পাট উঠিয়ে চলে যায়। আতান্তরে পড়ে গ্রামের মানুষ ঘর ছাড়ে। থেকে যায় ঈশাই বুড়ি আর তার লদরপদর বেঢপ মুখের নাতি ঈশ্বর। তারা পাটক্যার।
      এই উপন্যাস জুড়ে দুই মকরজলের জীবন-বেদনার মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে সাবঅলটার্ন মানুষদের কথকতা। দুই মকরজলের নামও ভারি অদ্ভুত। একজন, ইশ্বর,ঈশা পাটক্যার।কাঠ ছুতার, মাঠ ছুতার, সবার নীচে পাট ছুতার। ঈশ্বর হলো সেই পাট ছুতার।মরাঘর খুঁজে বেড়ায় আর হাঁক দেয়,"কই গ কত্তারা!পাটক্যার আসিচে পাট লিয়ে।" দ্বিতীয়জন, ঈশার মকরজল ভগবান,হাভাতে ছেলে সে।জন্ম দুখি সূরিখেপির ব্যাটা। বেদো ব্যাটা। মকর সংক্রান্তির উদীয়মান সূর্যকে সাক্ষী রেখে পাতিয়েছিল এ সম্পর্ক।আর আছে রাইমতী। ভরাশীতের কুয়াশা রাইমতী,মায়াবিনী রাইমতী,মন খেলুড়ে রাইমতী।মধুশালা রঙের মিঠা মেয়ে রাইমতী মন দেয় লোকের কাছে চিরকেলের ঘৃণার পাত্র,জন্মলগ্ন থেকে কপালে সেঁটে যাওয়া বাখান বেদো ছেলে ভগবানকে। মন দিয়েছে,ভালোবেসেছে,ঘর করেছে বনের ধারে ফাঁকা ডাঙায় ঘর বেঁধে।
         এদিকে জলের অভাবে গৃহপালিত পশুদের মড়ক লাগে। বিষয়-আশয় সব ফেলে ডুংরি থেকে পালায় মানুষ পেটের জোগাড় করতে আর সুযোগ বুঝে কোপ মারে সুবোধ ঠাকুর। যে যে যেতে চায়,তার বিষয়-আশয় কিনে নেয়।
        জল শেষ হয়ে যায়।বাতাসকে ভারী করে চলতে থাকে ঘাঁটু ঠাকুরের দীর্ঘশ্বাস আর জলরূপী হরি ঠাকুরের আঁতছেঁড়া হাহাকার।
         মণিশংকরের তৃতীয় উপন্যাস 'লালডুংরির কোল'।পেশায় শিক্ষক এই তরুণের আরও দুটি অনন্য উপন্যাস,'কালু ডোমের উপাখ্যান' আর 'লোহার'।
মুগ্ধ হয়ে ছিলাম 'কালু ডোমের উপাখ্যান' পড়ে।লোহার ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছিল। তখন পড়া। আলোচিত উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামী জীবনের চিহ্ন। লুপ্তপ্রায় জাদোপাটক্যার জনজাতির জীবনের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংরক্ত থেকে তাঁদের ইতিহাস,সংস্কৃতি,যাপন-সংগ্রামকে তুলে এনেছেন গভীর আন্তরিকতায়।অন্য দুটি উপন্যাসের মতো এই উপন্যাসটিও পাঠক-হৃদয় জয় করবে।

         লালডুংরির কোল/মণিশঙ্কর
          প্রকাশনা : পরম্পরা প্রকাশন
           প্রচ্ছদ : মণিশঙ্কর ও চন্দন মিশ্র
            মূল্য : ₹২৭৫








যে অন্ধকার মায়াময়


        'আমি ত নিজের মতোই দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজের রাস্তায়/জানতাম না আমার পরিচয়/কি দরকার ছিল রাস্তা ভুলিয়ে দেওয়ার? পথ ভুল করলাম বলেই ত/ টিকিট না কেটে ভুল ট্রেনে চড়ে বসলাম/ আর টি.টি.ই. নামিয়ে দিল এক অজানা অচেনা অনামা স্টেশনে। সেখান থেকে বেরিয়ে চলতে চলতে/ পৌঁছে গেলাম নিজের নামের ফলক লাগানো বাড়ির সামনে/কলিং বেল বাজাতেই ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এল যে/তাকেই স্বনামে ভাবতে বাধ্য হলাম যে!'(কণ দরকার থিলা?/কী দরকার ছিল?)  শুরু এভাবে,এই লেখা দিয়ে। 
          পরের লেখাটি একটু দেখি, 'অনেক বছর পরে/ আজ সেদিনের রোদ এল, রোদের সবুজ পোশাকে ঝরে যাওয়া জবার পরাগ/এই রোদকে কি বলে দেব/আমার শরীর আর মন এখন আলাদা।এই শরীর ভয় পায়/ বহুদিন থেকে বন্ধ থাকা/কলিংবেলের শব্দকে।'(সেদিনর খরা/সেদিনের রোদ) কলিংবেলের শব্দে কি কবির অপেক্ষায় থাকা প্রত্যাশা ধরা পড়ে?এই অপেক্ষা কিসের ভাবতে ভাবতে কবির সঙ্গে হেঁটে যাই আর শুনি খুব স্পষ্ট কণ্ঠে তার উচ্চারণ,'আমার ভেতরে একটা জঙ্গল জেগে উঠেছে আজ...' । এ কবিতার শেষে কবি উচ্চারণ করেন, 'আমাকে যদি কেউ কোথাও খোঁজে/যদি কোনো দায় থেকে যায় আমার?আমার ভেতরে জেগে উঠেছে জঙ্গল/ না জঙ্গলের ভেতরে আমি/এই সত্যটি ছাড়া/ আর আলাদা বাক্য গড়ার উপায় নেই আমার কাছে'।(বর্ষ পরে বর্ষ/বছরের পর বছর) কী বলব এ উচ্চারণকে?
       মনে পড়ে যায়,'গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
                                  আমাকে কেন জাগাতে চাও?
       হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল,হে স্মৃতি,হে হিম হাওয়া
                                 আমাকে কেন জাগাতে চাও কেন।' জীবনানন্দের কবিতার এই লাইন... অন্ধকারের কবিতা,মায়াময় অন্ধকার অথবা মায়াবী অন্ধকার।
         ফিরছি, কবি মমতা দাশের কবিতায়। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষা ভিতরে' কবিতার শুরুতে লিখলেন, 'গাড়ির মধ্যে বর্ষা/বর্ষার মধ্যে গাড়ি'।আবার এই কবিতার আরেকটি পংক্তি--'একই সময়ে,প্রতি ঘরের ড্রইংরুমে/নিতান্ত ভদ্রলোকের মতো বসে আছে/এই জীবন...' খুব গভীর এই অন্তঃস্বর।এক রহস্যময় প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন যেন!তাই অনায়াসে তিনি বলেন, ' এই রাতটি অন্তত থেকে যাও/আমার কাছে,পরস্পরকে বলে দেব সত্যি কথাটি/কল্পনা অথবা সম্ভাবনা থেকে ত পার পেয়ে যাব/ চলো,এই একটিই তো রাত!' রহস্যময় সেই প্রেমিকের সাথে তাঁর মান-অভিমান,
মিলন,বিচ্ছেদ।
           'তারপর আমার রাতগুলি পরতে পরতে খুলি/চালতে গাছের পাতার আড়াল থেকে পেঁচার ডাক/খামারবাড়ির চাঁদের আলোয় সাপের রাজা ও রানির সংগম নৃত্য/আমি কি সত্যি সেই মেয়ে/যাকে একদিন ডেকে নিয়ে গেল নাছোড়বান্দা এক ভূত/ক্যানাল দিয়ে প্রবাহিত সবটুকু জল/বলেছিল,নিয়ে যেতে ঘরে/সেই জল শেষ হয়নি/যেমন,ভূতের আধিপত্যও' (বায়া চঢ়েই)
   অদ্ভুত ভাবে মিশে গেছে পরাবাস্তব ও বাস্তব। অথবা এই পংক্তিগুলি, 'যেন একগুচ্ছ মচকানো ঘাস/শীতের আকাশের দিকে/একমনে চেয়েছিল,এক বিন্দু শিশিরের আশায়।/যেন,শামুকটি যুগযুগ অপেক্ষায় ছিল/কখন কোমল কোনও হাত/তুলে নেবে তাকে...' (মায়ান্ধকার)
   প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে।পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা।আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ 'মায়ান্ধকার'-এর বেয়াল্লিশটি কবিতায় সেই উচ্চারণ কখনো গভীর,কখনো শীতের রোদের মতো ছুঁয়ে আছে। ওড়িশার স্বনামধন্য কবি মমতা দাশের কাব্যগ্রন্থ 'মায়ান্ধকার' পড়ে এমনটাই মনে হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় ধরা পড়েছে এক সংবেদনশীল,সচেতন মানুষের আত্ম-অন্বেষণের অভিজ্ঞতা। নিয়তিপীড়িত,বেদনাগ্রস্ত এই জীবনকে ভোগ করে,সহ্য করে,একে অতিক্রম করার প্রক্রিয়ায় কবি সৃষ্টি করেছেন এক উজ্জ্বল কাব্যলোক। কবি মমতা দাশের ওড়িআ সাহিত্যে অবদান হিসেবে রয়েছে নয়টি কাব্যগ্রন্থ, একটি উপন্যাস, চারটি গল্প সংকলন, পনেরটি অনুবাদ পুস্তক।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বৌ ঠাকুরাণীর হাট' ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো'র ওডিআ অনুবাদ করেছেন এই কবি।তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'একত্র চন্দ্রসূর্য'-এর জন্য ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন 'ওড়িশা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার'।এছাড়াও বিভিন্ন সারস্বত সম্মানে ভূষিতা এই কবি আজও নিয়মিত লিখে চলেছেন।শেষ করব এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা 'মায়ান্ধকার'-এর একটি পংক্তি দিয়ে : 'এক টুকরো রঙিন মেঘ/কবে যেন ওড়ালো আকাশ/জীবনবৃক্ষের শাখা /তাকে ধরে রেখেছিল/এমন পরিবেশে আমি আর সে/হাতে হাত রেখে,পরিচয়হীন/ছিল না পায়ের চিহ্ন মাটির ওপরে/কোনও, আমরা যুগ্ম,অদ্বৈত,বিমূর্ত!'

          মায়ান্ধকার/মমতা দাশ
          প্রকাশনা : শ্রদ্ধা পাব্লিকেশন
           প্রচ্ছদ : শশিকান্ত রাউত
           মূল্য : ₹১২০


---------------------------------------------------------------------------
Artist - Romena Debnath



ধারাবাহিক বই আলোচনা :-


সব্যসাচী মজুমদার 

নিয়ত সংশোধনের তিনটি আবহমান রেখা

     লেখালিখি করা তো আর কিছু নয়, নিজেকে নিয়ত সংশোধনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া। আজীবন ধরে একটাই রচিত হয়,যা কাল পেরিয়ে পাঠককে মুরীদ করে।আর বাকিটা তো প্রস্তুতি ক্রিয়া। বাংলা কবিতার নির্জনে যে কয়েকজন সঙ্ঘবাসী এই রহস্যে উদ্বেল হয়েছেন,তাঁদের‌ই চারজন এ আলোচনায় এবারে থাকছেন। মানে এই ক্ষেত্রে এমন তিন তরুণের ব‌ই পড়েছি,যাঁরা লিখতে আসেননি,লেখা তাঁদের নিয়তির মতো---বলেই বিশ্বাস।

       প্রথমে যে ব‌ইটিকে আপনার কাছে রাখতে চাইছি, বিশ্বজিৎ দাস প্রণীত 'ক্রাইম কবিতা'। শূন্য দশকের শেষ দিকে লিখতে শুরু করা বিশ্বজিতের এই দ্বিতীয় কাব্যটি অত্যন্ত আগ্রহ তৈরি করে বৈকি! অর্থাৎ থ্রিলার পরিবেশিত কবিতার কূহকে। রেওয়াজ নতুন নয়, নতুন হলো থ্রিলার। কৌতূহল হয়।কৌতুহল‌ই ব‌ইটি খুলিয়ে হঠাৎ থমকে দেয় ভূমিকায়।লেখা হচ্ছে,"বেস্টসেলারের তালিকায় চিরদিন গল্প-উপন্যাসের ব‌ই। কবিতার ব‌ই সেভাবে মননশীল পাঠকের কাছে সমাদর পায়নি।"না আমি চাই না,কেউই চান না বাংলা বেস্টসেলারের দীর্ঘ করুণ তালিকায় কোন‌ও কবি অন্তর্ভূক্ত হোন। অন্ততঃ এই বেস্ট সেলারদের মৃত্যুর পর যেভাবে গণ মুছে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলে,সে তালিকায় ব্রম্ভ ও পুঁতির মৌরির অনুপস্থিতি কী ভূমিকা লেখখকে ভরসা যোগায় না!

       কবিতা ধীরগামী কিন্তু দীর্ঘায়ত। জনপ্রিয়তা তৈরি হয় না কবিতার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। নাটকীয়তা তাকে আপাত সংযোগক্ষম করে তোলে বটে কিন্তু এই নাটকীয়তাই রহস্য ম্লান করে দেয় অধিকাংশত।এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে,প্র ণা বি একদা রবীন্দ্রনাথের পাঠকদের ওপর ভরসা করে তাঁদের মত মতো সংকলন গ্রন্থ চয়নিকা তৈরি করেছিলেন।বাকিটা ইতিহাস‌ও সম্ভবতঃ ভুলে গেছে। বৃহত্তর পাঠক আর মননশীলতার খুব সুন্দর সম্পর্ক নয়।আর কবিতার পাঠক কম হবে এটা স্বাভাবিক। কেননা'পাঠকের হাততালি কবিতার গায়ে ব্যাথা দেয়।'আর একটি তর্ক,বাংলার নিবিষ্ট কবিতাপাঠ সাধকদের কী লেখক অমননশীল বলেই চিন্হিত করতে চাইছেন!

        যা হোক,এই অনৈক্য পেরিয়ে প্রবেশ করা গেল বাংলাভাষায় রচিত সম্ভবতঃ প্রথম ক্রাইম কবিতায়।
       মোট তিনটি স্তরন্যাসে(পানপুর‌ওয়ালার কিসসা, শুভাগত রহস্য,অনিমা মণ্ডল মার্ডার) রয়েছে মোট চল্লিশটি লেখা।সবকটা মিলে উন্মোচন করেছে একটা আখ্যানের কূহক। সামগ্রিক ভাবে টান টান উত্তেজনার। কিন্তু আখ্যান, অক্ষরবৃত্ত বিণ্যাসের আখ্যান কতটা কবিতা হয়ে উঠলো!বলা ভালো আমাকে নিষ্ঞাত করলো--এটাই প্রশ্ন। কতবার এ লেখা পড়বো কিংবা এ লেখারা কতদিন পর্যন্ত মুগ্ধ করবে--অনেক পরের কথা ‌‌‌। আমার প্রাথমিক পাঠের বেদনায় জানাই বাংলা কবিতার লিরিক সংবেদন কিন্তু লেখাগুলিতে ভরপুর।আখ্যান ব্যাতিরেকেও একটা একটা লেখা আলাদা করেই চোখে পড়ে,"একটি টিকটিকি ঠিক ঠিক বলে উঠেছিল/আর তখনই দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের/পচা ডিমের ইতিহাসের মধুরিমায় পড়লো/ ছেদ! আপত্তির মতো সকালে আশংকা সত্যি হলো!/কী সেই সত্যি? পরিকল্পিত হত্যা? না কি/পানপুর ডনের হাস্যরসাত্মক ড্রামা?/খবরের শিরোনামে আজন্ম লালিত পণ্ডিতজির/ম্যায় পানপুরওয়ালা,ম্যায় হুঁ বিলাস/একটি অর্জন!"(পানপুর‌ওয়ালার কিসসা:১)। আপনি খুব সচকিত হবেন না, বিচিত্র শব্দ বিন্যাসে, কিন্তু সচকিত হয়ে কবিকে পড়তে শুরু করবেন। কেননা এই প্রথম লেখাটি যেমন অনায়াসে একটি টিজার,একটা প্রবেশক কিংবা নিজেই একটা সম্পূর্ণ কবিতা। এভাবেই একটা একটা করে নিরবচ্ছিন্ন প্লটকে লিপ্ত করে তুলতে দেখছি।প্রত্যেকটাই একটা স্বতন্ত্র মনস্তাত্ত্বিক বাবল গড়ে তুলছে। অথচ এই সব বাবল গুলো একে একে পরিণত হয়েছে একটা স্ফিয়ারে।যাঁকে কবি থ্রিলার বলছেন।এ পাঠকের মনে হচ্ছে এক বিস্তৃত দিনলিপির সারাৎসার,"কুড়ি বছরেই বিলাসের শরীরে এল হত্যার/রক্তবর্ণ মেঘ।ক্ষমতা আর প্রেমের সমন্বয়ে/পৃথিবীর আদিতম পিতা হয়ে উঠল/রেখেছে ছেলের নাম আকাশ,/গূঢ়ার্থ!"(২)

    আপনার মনে পড়ছে নিশ্চয়ই ছোটোগল্পে বিনয় মজুমদার কীভাবে বিনয়-স্ফিয়ার গড়ে তুলেছেন।এ গ্রন্থনা স্মরণ করাচ্ছে।কবি একটি নির্দিষ্ট ফরমে গেঁথে দিচ্ছেন তাঁর প্রতিদিনের দিনলিপি।এই তো সামন্তরাজনীতি,যোগ্যতমের টিঁকে থাকার অনিবার্যতা একটি নিশ্চিত আখ্যানের ভেতরে উন্মোচন হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে প্রণীত হয় প্রতিস্পর্ধার আর্বানিকরণ,"আট পুলিশের দেহ । বাকিরা আহত/কিংবা জীবনের ঝুলন্ত চাঁদ দেখেই/ছুটছে পাগলের মতো যেমন মৃত্যুর/আশেপাশে জেগে ওঠে অস্ত্রের ঝংকার...(১৩)
      
        না গল্পটা আমি বলবো না।অনেককে দেখেছি মূল না পড়ে আলোচনায় গল্পটা জেনেই বুকনি ঝাড়ে। আপনিও জানেন না, আমিও না--তাঁদের কেউ কেউ এই লেখা পড়ছেন কিনা!তাই কবিতায় থ্রিলারের স্বাদ পেতে গেলে ব‌ইটা কিনতে হবে।আমি বড়োজোর বাংলা কবিতার দুটো পংক্তি উদ্ধার করে দিতে পারি,"মহিলার মাথা থেঁতলে, নিম্নাঙ্গ ফেড়ে ফেলে/নৃশংস এক আয়না দেখে পালিয়েছে।"(শুভাগত রহস্য:৪)। আপনি অবশ্যই এতক্ষণে বুঝে গেছেন সামান্য ঘটনাকে,এই তো প্রায়শই ঘটনাকে রিপোর্টাজ থেকে বিমূর্তে পৌঁছে দিতে যে কবি পারেন, শক্তিশালী,"রকি স্বীকার করেছে, মাংস কাটতে কাটতে /ঘিলুর দৃশ্যাবলি তাকে অদ্ভুত আনন্দ দিত..."(১২)।

        কবি এখানে সর্বজ্ঞ কথকের ভূমিকা পালন করে উল্লম্ফন-প্রতিউল্লম্ফনে ধরে রেখেছেন গল্পের আমেজ‌ও।পর্ব-পর্বাঙ্গেরা‌ও পরষ্পর সন্নিহিত কবিতার সম্পূর্ণ তাগিদে--"আঁখি পল্লব জেনেছে/শেষ বার নিভে যেতে কতটা সোয়াদ?"(অনিমা মণ্ডল মার্ডার:৩)।
          
          এবার এ ধরনের অবলোকন কতটা কবিতা হয়ে উঠেছে,কতটা পদ্যে লেখা আখ্যান হয়েছে,কতটাই বা আবহমান কবিতার জন্য নতুন হয়েছে---সে বিচার আপনার আর সময়ের।এ ব্যাপারে নির্ণায়ক হয়ে মূর্খামির ভার আর না বাড়িয়ে একটা কথা অবশ্যই বলতে পারি,এ ব‌ই কিনে না পড়লে কিন্তু এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষা আপনার না জানা থেকে যাবে।

         ধরুন, আপনাকে বললাম---স্বল্প দৈর্ঘ্যের কবিতা শুনলেই বাবা সিগারেট ধরাতেন।কিংবা দীর্ঘ কবিতার কথা বললেই বাবা দীর্ঘশ্বাস নিতেন।কী মনে হয়!একটি আত্মজীবনীর গদ্য অংশ। এক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের অনুমান ঠিক হলো না। গালিব উদ্দিন মণ্ডল এই ভাষাটাই ব্যবহার করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক কাব্য 'বাবাস্কোপ'এ। ভাবতেই ভালো লাগছে বাংলা কবিতার ভাষা ক্রমশঃ আবার মুছে দিচ্ছে গঠনের ভেদরেখা।একে আপনি কেবল অবগাহনেই গ্রহণ করতে পারেন।

         গালিবের কবিতার কোন‌ও সচেতন নির্মাণ নেই।এ গ্রন্থ পড়তে পড়তে টের পাই এক বিরহীর নিস্পৃহ দিনলিপি।যার অঙ্গে অঙ্গে মোনাজাত,"বাবারা স্বয়ংসম্পূর্ণ বায়োস্কোপ।/ট্রেলার আসলে হাওয়ার ভয় আগলে /পাতাঝরা তাসের ঘরহারা বারান্দা।" কিংবা ,"হুগলী সেতু থেকে হাওড়া ব্রিজের/দূরত্ব মাপক অনুভবটির নাম বাবা।/সেতুরা শূন্যস্পর্শী।পিতারা /সমাহিত শিশু।/জলের শব্দ‌ই তো যোগাযোগ।/যোগাযোগের নৈঃশব্দ জল।"(সেতুশিল্পী)পূর্বজ দুই কাব্যচিন্তাকে অতিক্রম করে এ গ্রন্থ কবির নতুন স্বর হয়ে ওঠে যখন তিনি লিখছেন,"পিতা হয়ে ওঠার খেলাটিতে /আপনি কি নিজের কাছে ফিরতে চান?/নাকি সূর্যের উত্তর না নিয়ে /নিজেকে সৌরমণ্ডলের নিত্যনতুন আবিষ্কারে জাগিয়ে রাখতে চান?" (একটি ইচ্ছাধারী খেলার ব্লু-প্রিন্ট)অথবা,"আশেপাশেই আমাদের ভ্রুণের ভিতরে/ ভ্রমর ঢুকে পড়েছে /আমৃত্যু আমরা গ্রামাফোন খুঁজে চলেছি/মৃগনাভি হারানো হরিণটিও/একবার শ্মশানে যাচ্ছে /আর একবার কবরস্থানে/একবার জিয়ারতে আর একবার তর্পণে।"(ছড়ানো পথ)।'মৃগনাভি'শব্দের ভিন্ন একেবারে ভিন্নতর এ ব্যবহারে মুগ্ধ হতে হতেই আপনি স্হিত হবেন'কবরস্হানে'আরবি ও তৎসমের এহেন সম্পৃক্ত লোকায়তিক গতায়াতের সঙ্গে মিশে যায় কার্যকারণে তখনও কিন্তু প্রাজ্ঞ আপনি মোহিত হয়ে আছেন ভ্রুণের ভিতরে ভ্রমর ঢুকে পড়ার অবিশ্বাস্য দৃশ্যকল্পে। মনে পড়ছে নাকি 'আপক্ক বেদনা'!যে বেদন তৃপ্তিতে ঝরে 'শস্য ফলনের হাসি'

           গালিবের কবিতা আপনাকে গ্রস্ত করবে ধীরে,অনিবার্যতায়। গুনগুন করে তিনি  পিতা হি পরমন্তপকে বিন্যস্ত করেছেন সর্বার্থধারায়।একটি দর্শনের স্থিতিকে আলম্বনে যেই গালিব শুরু করেছেন দৃশ্য নির্মাণ,একটা আবহমান টুকরো টুকরো হয়ে আবার একটা কোলাজ তৈরি করে নতুন আকৃতি নিচ্ছে।গালিব স্বরমণ্ডলে বলছেন,"সরল জ্যোৎস্নার জাহাজে ম্লান তারাদের আড্ডা।/ছায়াপথঘেরা ব্রম্ভাণ্ডের এই চা-দোকানে /কালপুরুষকে কোন‌ওদিন‌ই মুখ ফুটে কিছু /বলা হয়ে ওঠে না প্রবাসী নক্ষত্রের।"(প্রথম অ্যাকোয়ারিয়াম)। আপনি বুঝতেই পারছেন পূর্বে পঠিত গ্রন্থের মতোই এ গ্রন্থ‌ও একটি পৃথক গোলক তৈরি করে দেখাতে চাইছে তার নিরুপিত পিতার সর্বতিশায়ী অস্তিত্বকে।এখানেই গালিব হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার একটি স্বর হয়তো বা।যার বিশ্বধারণাকে আমরা এখনও জানি না সম্পূর্ণ,"ইডিপাসকে ওয়াশিং মেশিনে ঘুলিয়ে/হ্যাঙারে টাঙিয়ে/বাবারা মাকে/পরশুরামের কুঠার উপহার দেন।"(ফ্রয়েড)। বাংলার সমস্ত কবিতা জন্মায় জীবনের নিরুক্ত প্রহরে। পড়তে পড়তে আপনিও বুঝতে পারছেন গালিবের সেখানে দলিজ।
              
        দু'হাজার পরবর্তী পর্বে কবির বৃহত্তর স্বকাল দর্শন।আর সেই দর্শনগ্রাহী চিন্হগুলিই একে একে প্রোথিত হয়েছে শূন্য সাধকের কাফিলায়,"ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি।/মহরুমা নারকেল নাড়ুদের আত্মা/ভরে নিয়েছি সিলভারের দোমড়ানো টিফিন কৌটোয়।/বিদেহী হার্ডডিস্ক ফরম্যাট করে ভরে নিয়েছি/পারলৌকিক আতর।/দেশলাই খোলের ভিতর ভরে নিয়েছি বিদূষক পোকা"(একটি পারলৌকিক বন্দিশ)।গালিব একটি মধ্যবর্তী সময়প্রমার শরীর ফুটিয়ে তুলেছেন।জায়মান বাস্তব ক্রমশঃ ভার্চুয়াল হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে মিডিয়ার সংজ্ঞা। সমাজের প্রত্নপ্রতিমারা আকার বদলে নিচ্ছে। সেই বদল পর্বের মফলসলকে তুলে ধরতে ধরতে কবি একটা আস্ত বিবর্তনের অব্যবহিত বিস্তারকে তুলে তাঁর নিজের দায়কেও স্বীকার করে নিলেন।শেষ অবধি কিন্তু নিরাসক্তি বদলে গেছে লিপ্ত সহবাসে। বস্তুত সাম্যবাদী শিল্পের দায় স্বীকার করে নিলেন শেষাবধি।একটি কাল রণনের ভাষা পাওয়ার চেষ্টা করলেন গালিব এই অবকাশে,"একটি চুল্লুখোর টাইম মেশিনে/ঠিকমতো চড়লে /মাটির মুসাফিরকে/আর কে পায়!/আমাদের অপেক্ষা /মূলতঃ হারিয়ে যাওয়া/টাইম মেশিনের চালকটিকে ঘিরে।"(নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা)।

           আপনি এতক্ষণে আমার সঙ্গে একমত যে দুটি গ্রন্থকেই সংগ্রহে রাখতে হবে স্রেফ বাংলা কবিতার আগাসময়ের জন্য। আরোপিত রংগুলিকে ভেদ করতে করতে দুই কবির‌ই দৃষ্টি পিনদ্ধ ঈশ্বর কণায়।প্রতিনিয়ত দুজনের রচনাই মাথার মধ্যে বোধ তৈরি করছে  জায়মান-বিজায়মানতার দ্বন্দ্বসূত্রে। হয়তো আগামিকবিতার শরীর নির্ণীত হচ্ছে।গালিব জানাচ্ছেন,"শিরশিরে এই হাওয়ায় /নিমগাছের পাতার মতো কাঁপছে নিরালা জিকির/ছায়াছবিরা ছবির অধিক ,অধিকঘন সে তৃণাচ্ছাদিত ছায়া।/স্বরচিত ছায়াঘরে সকলেই সহজ ফকির।"(বাবাস্কোপ)।

     এবার সঙ্গত কারণেই আলোচনায় আসবেন মৌলি তরফদার।প্রথম দশকের শুরুতে লিখতে শুরু করা এই কবির দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভেই প্রকাশিত হলো তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'সোনা বালি ও রসাতল।' আপনি বুঝতেই পারছেন কী বিপর্যয় নেমে এলো আপনার রাজনৈতিক সচেতনে। আপনার মনে পড়ে গেলো সুবর্ণরেখা নদীর তীরে বালি থেকে সোনা কুড়োতে কুড়োতে রসাতলে যাওয়া সংসারগুলোর কথা। আবার এক‌ই সঙ্গে আপনার মনে পড়তে পারে উটপাখির লোকোত্তর সমকাল। দুটো সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে প্রবেশকে কবি জানাচ্ছেন,"কেন ভাঙছো, আক্রোশের দীর্ঘ শরীর;/আহত‌ই আছি, তুমিও রাতদুপুরে এসো,/দুমড়ে দাও বুকের ছাতি অকারণ;/পাগল তুমি, তোমার‌ও দেহের আগল খুলে/দাউ দাউ আগুন ও বজ্রাঘাত দেখা যায়;" লক্ষ্য করুন, একটি প্রত্যক্ষ প্রত্যয় সাজিয়ে যাচ্ছে পর পর নির্ধারিত পংক্তিগুলিকে। কবিসত্তা জানে তাকে কী বলতে হবে। কিন্তু মৌলি জানেন না।তাই এরপরেই পাঠককে হতচকিত করে প্রবেশকে রচিত হয়,"তোমাকে আমি নতুন শর্তাবলী দেব,/দেব সঞ্জীবনী গাছ,ভাঙা ঘর গড়ার সময় দেব।/আমার লক্ষ্য সঙ্গে নিও তুমি,বেড়া দিও চারিপাশে।" 'আমি' শব্দটি অনায়াসে ব্যাক্তি চিন্হ অতিক্রম করে মনে করিয়ে দিচ্ছে দুটি আলাদা বাবলের একত্র সহচারণে নির্মীত একটি কোলাজব্যাপ্তি।যার মধ্যে রয়েছে একটি জায়মান অথচ অপ্রণীত বিশ্ব। মহিলা কবি, মেয়েদের কবিতা ইত্যাদি আরোপিত ফেনোমেনা শূন্য দশকে ভেঙে দিয়েছেন সঙ্ঘমিত্রা হালদার, দেবলীনা ঘোষ বা অনুরাধা বিশ্বাস প্রমুখেরা। একারণেই মৌলি হয়ে উঠেছেন অপ্রণীত বিশ্বের কবি। সময়ের কারণেই।কবি তৈরি করেছেন তাঁর স্বনির্বাচিত স্পর্শকাতরতা,"আর আমি অনুভব করছি অনুপম/আমার হারানো এ তাবৎকাল অরণ্য প্রান্তর"(স্পর্শকাতরতা:৩) কিংবা,"তাহলে ভয় পাওয়া মানুষদের মুখে তালা তুলে ধরো/বাসন আর হাড়ের ঠোকাঠুকি--বাড়ি ভাঙার শব্দ।"(স্পর্শকাতরতা:২)।
          
            বিশদ পাঠের পূর্বে জানিয়ে রাখি,যখন গ্রন্থ পড়বেন, খেয়াল করবেন যতি চিন্হ ব্যবহার। বাংলা কবিতার ইদানিঙে যে ব্যবহার নৈপুণ্য দুর্লভ। বক্তব্য বিষয়ে দখল না থাকলে এহেন মতি ব্যবহার করে একটা এবসলিউট সত্তা হয়ে উঠতে পারে না কথক।যেন নিশ্চিত ভাবে স্রষ্টা একে একে পেটিকা উন্মোচন করে দেখাচ্ছেন যাবজ্জীবনের ইতিহাস রেখা।যে রেখায় রসাতল পরবর্তী মানচিত্র কামনা থরোথরো বলে ওঠে,"আজন্ম শীতলপাটি আর রাখালের গল্পের ভিতরে তার দেশ/আধপাকা চুলের ওই হারিয়ে ফেলা নিশ্চিন্ততায়/আমার ভয় পাওয়া /পাব না,যাব না কোনোদিন সুদূরের পথে/যা কিছু আশৈশব তাকেই স্পষ্ট করতে হবে।"(অনিশ্চিত)।একটা একটা করে প্রশ্নের মুখোমুখি করে কবি আমাকে ভাবিয়ে নিচ্ছেন অনিবার্য আশ্রমের কথা।আবহমানের যে তপোভূমায় মানুষ পেয়েছে তার কথাপৃথিবীর স্বাধীনতা,"সন্ন্যাসীর মতো মমতাবিহীন আমার চোখে একাকী রাতে /উঠে আসি আমি, মায়াহীন সন্ন্যাস;যত বর্ণচোরা শিশুর /কান্নায় মৃত্যুর আহ্লাদ স্পর্শ করেছি তত‌ই কুয়াশা দিয়েছে/ধরা,যেন মেঘের ভিতর চাঁদের অপরাধ-দর্শন খুঁজে ফেরে,/লোভাতুর উচ্ছিষ্ট কম্বল ‌"(অপরাধ-দর্শন)।

        মৌলি তরফদার যে সময়ে লিখতে এসেছেন, কবিতার ভাষা অনেকটাই চলতি নির্ভর। অনেক নতুন ও নবগঠিত শব্দ প্রবেশ করেছে সেই নব্ব‌ইয়েই। কিন্তু কোন শব্দটিকে কবিতায় ঠাঁই পাবে--এটি নির্ভর করে কবির ধী-এর ওপর।যেমন দেখুন না,একদা 'এন্টেনা'শব্দটি বহুল প্রচলিত ছিলো। আমাদের রেফারেন্স মনেও পড়ে যেতো। এখনও যায়। তবে শব্দটির ব্যবহার অধুনা বিলুপ্তপ্রায়।আর কিছু পরের প্রজন্ম গুগল ব্যবহার করে তবে জানবে বস্তুটি কী!আর‌ও কিছুটা ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক গবেষণায় সহায়ক হবে শব্দগুলি। কিন্তু কবিতাটির কী হ‌ইলো!না,সে তো অনেক দিন আগেই দম আটকাইলো!এ কারণেই জীবদ্দশায় মহাজনের নামটাও লুপ্ত হয়ে যায় মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই। বড়ো ভয়ংকর এই কবিতার খেলা।মৌলি একারণেই অত্যন্ত সচেতন ভাষা প্রয়োগ করলেন।যে পথে হেঁটেছেন রমেন্দ্র কুমার,গীতা চট্টোপাধ্যায় কিংবা দীপংকর বাগচী বা প্রদীপ করেরা কিংবা যে সিম্ফনিতে মাতিয়েছেন চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়,সে সবের চর্চিত রণন শোনা যায় মৌলির ভাষাচেতনায়,"ক্ষয়িত জঙ্ঘা নিয়ে পার্শ্ববর্তী গর্তের ভেতর /মাথা নিচু শুয়ে থাকে দীর্ঘ গুহা ,টিলা সমগ্র--/নিজস্ব সাধ গুঁড়ো হ‌ওয়া নারী-পুরুষ/নষ্ট করে পাহাড়চূড়া/তারপর একা একা ফুলের বাগানে /দেখা হয় বকুল ও কৃষ্ঞচূড়ার"(গন্তব্যহীন)। আপনার ভাষার কথা আর মনে নেই।ছবি দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাচ্ছেন,"সহসা পথের উপর/সপাট অবতরণ/হাত আর হাঁটুর মাঝে /উঁকি দেয় আধফোঁটা মাথা"(দুঃখগ্রন্হি)।এ কাব্য অনায়াসে ভাষা অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছে স্বতোৎসারিত পরা-দৃষ্টিতে। কেবল", দীর্ঘ পথের চেয়ে /পর্যটকের প্রতিই আগ্রহ বেশি তার"(নীলকন্ঠ)।
            গ্রন্হটি বাংলা আবহমান কবিতার রীতিকে ওতোপ্রোতভাবে অনুসরণ না করে ছন্দদক্ষতায় ভাংলেন প্রথাগত রীতি ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌স্পন্দ-
মানতায় ধরলেন চলন। আগাগোড়া একটি জায়মান মানচিত্র এঁকেছেন স্পন্দিত ছন্দে যা বাক প্রতিমায় অত্যন্ত সাযুজ্যমান। এ কাব্যগ্রন্থ বাংলা সমকালীন কবিতায় যে ধ্রুপদ বিবর্তমান,তার‌ই একটি অংশ,"আকাশ দাঁড়ায় মেঘেদের নদীপাড়ে এসে,/দ্যাখে দোপাটির ছায়ায় স্মারকস্তম্ভের গায়ে/ঝিরিঝিরি পড়ছে অনুভূতি ধারা।"(সামাজিক-রহিত)।
            আগামী জীবনে মৌলি তরফদার যে সমগ্র রচনা করতে চলেছেন,এ ব‌ই তার‌ই একটি সর্গ।হে প্রাজ্ঞ,ব‌ইটি সংগ্রহের পর আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতো অপেক্ষা করবেন পরবর্তী সর্গের জন্য।


ক্রাইম কবিতা: বিশ্বজিৎ দাস;প্ল্যাটফর্ম;প্রচ্ছদ: সুপ্রসন্ন কুণ্ডু; মূল্য:৮০টাকা

বাবাস্কোপ: গালিব উদ্দিন মণ্ডল; ছোঁয়া; প্রচ্ছদ: বিপ্লব ঘোষ; মূল্য: ১৩০ টাকা

সোনা বালি ও রসাতল:মৌলি তরফদার;অভিযান পাবলিশার্স; প্রচ্ছদ:পার্থপ্রতিম দাস; মূল্য:১০০টাকা










-------------------------------------------------------------------------

রান্নাঘরের লেখা - সন্দীপন দত্ত

রান্নাঘরের লেখা  - সন্দীপন দত্ত
প্রচ্ছদ  - রাহেল রাজীব
প্রকাশক - কবি মানস
বিনিময় মূল্য - ৬০ টাকা 
যোগাযোগ -  +৯১ ৯৮৩২৭৯৯৮৯৮


দ্বিতীয় গাছ  - তন্ময় বসাক

দ্বিতীয় গাছ - তন্ময় বসাক
প্রচ্ছদ - অর্পিতা মাল
প্রকাশক - সান্নিধ্য প্রকাশনা
বিনিময় মূল্য - ৩০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৫১১৮৬২৯৪



উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি আয়োজিত ওয়েবজিন প্রদর্শনীতে ওয়েব ডুয়ার্সকে সম্পাদকের প্রদর্শন করবার মুহূর্তের ছবি 





মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো ভালো কাজের যত্নশীল আলোকপাত। ধন্যবাদ সব আলোচকদের। মুগ্ধতা সব লেখকদের ।

    উত্তরমুছুন
  2. বই আলোচনাগুলো খুব ভালো লাগলো।্কবিতাও। অভিনন্দন জানাই সম্পাদক মহাশয় ও লেখকদের।🙏

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সংখ্যা ১৮ || বর্ষ ৫

ফেরার অধ্যায়: -২য় বর্ষ সংখ্যা ১৫