ধারাবাহিক উপন্যাস বেলাভূমি তৃতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
বেলাভূমি
জিৎ পাত্র
জিৎ পাত্র |
সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিল সবাই ।
বাইরে তখন অপেক্ষা করছে স্মিতা, অনিকেত, সৌরভ ।
ড্রাইভার রতনকে নিল স্মিতা ,মেশেমোশাই বারবার বলেদিয়েছেন স্মিতা যেন ড্রাইভিং না করে দেখো তোমরা । বোলপুরের আবহাওয়া আজ খুব ভালো মেঘলা নেই হালকা রোদ উঠেছে ।গাড়ি কিছু দূর যেতেই সামনের মোড়ে গলির সামনে দাঁড়িয়ে গেল । ঘড়িতে তখন পৌনে দশটা চিন্তায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো সুবর্ণের । দেবলীনা কি আর আসবে না ? নাকি কালকের ঘটনার জন্য আসতে দ্বিধাবোধ করছে ?
হঠাৎ গাড়ির জানালার ফাঁকা দিয়ে সামনের গলির দিকে লক্ষ্য গেল সুবর্ণের দেখলো লাল রঙের শাড়ি পরে দূত আসছে দেবলীনা। রোগা পাতলা চেহারা শ্যামল বর্ণ গায়ের রঙ কপালে লাল টিপ ,সামনে আসতেই হালকা হাসলো দেবলীনা ।
" কিরে এত লেট বললো স্মিতা "
" আজ টিউশুনি অফ করেদিয়েছিলাম যেই রেডি হয়ে বেরুবো অমনি বাবার শরীরটা খারাপ হলো তাই একটু লেট বললো দেবলীনা "
"আচ্ছা উঠে আয় বললো স্মিতা"
গাড়ি চলতে লাগলো, গাড়ির মধ্যে হাসি, ঠাট্টাতে চলতে লাগলো ক্লান্তি হীন যাত্রা,বোলপুর শহর থেকে সামনেই রবিঠাকুরের বিশ্বভারতী, এতদিন পাঠ্যবই এ পড়েছে,কিন্তু কোন দিন দেখার সুযোগ হয়নি। অগনিত পথ যাত্রীর ভিড় শান্তিনিকেতনের রাস্তায় , বেশিরভাগ টুরিস্ট, ড্রাইভার রতন বিশ্বভারতীর সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো।বিশ্বভারতীর প্রবেশ করল সবাই । একের পর এক ভবন ঘুরে দেখতে লাগলো সবাই । রামকিঙ্কর বেইজের শিল্প, কলাভবনের প্রতোক ছবি এক কথায অসাধারণ । নন্দলালের ছবি, নিখুঁত ভাবে দেখতে লাগলো সবাই । এত হাঁটাহাঁটি জন্য খুব ক্লান্ত লাগছি সুবর্ণকে । এইভাবে কোনদিন হাঁটেনি ও । তাই দেখে দেবলীনাকে, স্মিতা বললো "তোরা দুজনে একটু রেস্ট নে কোথাও । এই ভাবে দুজন আম্রকুঞ্জে গিয়ে বাঁধানে গাছের তলায় বসল । সারি সারি ছেলে মেয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে সবার পরনে পাঞ্জাবী, মেয়েদের বেশীর ভাগ শাড়ি পড়েছে । এই আম্রকুঞ্জে যুগলের ভিড় বেশী।
প্রান্তিক সমাহার বৈচিত্র্যময় ভাবনা প্রত্যেক মানুষের, এই ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছে ওরা,যারা ভালোবাসে, ভালোবাসে তাদের প্রিয় কবিকে,ভালোবাসে শান্তিনিকেতনের প্রত্যেক স্মৃতিচারণে,
"আপনার কবিতা ভালো লাগে , অবশেষে প্রথম কথা বললো দেবলীনা।"
ইতস্তত হয়ে উত্তর দিল সুবর্ণ " না সেই ভাবে কোনদিন পড়া হয়নি "
"কিন্তু রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ, সুভাস মুখোপাধ্যায়দের যে কোন ও বাঙালীর নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য পড়া উচিত । এই গুলো না পড়লে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় ।"
পড়েনি বলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। কী করে বলি বাড়িতে বইয়ের লাইব্রেরী আছে, বাবা- মা দুজনে পড়েতে ভালোবাসেন। কিন্তু স্কুল জীবনে ক্লাসের বই ,কলেজ এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে কবিতা
পড়ার সুযোগ পাইনি ।
" স্মিতার কাছে শুনেছি আপনি ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন ।"
" না সেই ভাবে পারিনা ছোটো বেলায় মায়ের কাছে শিখেছিলাম। "
স্মিতা ও বলছিল আপনিও ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন এবং ভালো কবিতা আবৃতি করতে পারেন , তা রবিঠাকুরের কাছে এসে বঞ্চিত হব "
" না না ও মিথ্যে বলেছে তেমন ভাবে ভালো পারিনা "
"ভালো হোক বা খারাপ শ্রোতা বিচার করবে"
" তবুও শ্রুতিমধুর না হলে শ্রোতার অভিব্যক্তি খারাপ হয়"
" শ্রোতা যদি অনভিজ্ঞ হয় তবে খারাপ ও শ্রুতিমধুর ''
এমন সময় স্মিতা , সৌরভ, অনিকেত ফিরল।
"চলো সামনে সোনাঝুরি ওইখানে গিয়ে বসি, বললো স্মিতা"
একটু হাঁটা পথ সোনাঝুরি,ওখানে হাট বসে , যুগলদের নির্জন স্থান।
সবাই বসে পড়ল ,এখন সময় স্মিতা বললো একটা গান কর দেবলীনা,
আজকের দিনটা স্বরণীয় হয়ে থাক , জানিনা ভবিষ্যতে আমরা কোথায় কে থাকবে "
অনেক আপত্তি করল দেবলীনা , এমন সময় সুবর্ণ বললো আপনি শুরু করুন আমি আপনার সঙ্গ দিতে পারি "
" এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
ভালোবাসি, ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,.
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির
জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে.
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে.
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী,
ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥"
ভালোবাসি
"ভালোবাসি, ভালোবাসি॥
সবাই একত্রে হাত তালি দিয়ে উঠল
"অসাধারণ গেয়েছিস দেবলীনা, বললো স্মিতা "
" তুই ও এত ভালো গাইতে পারিস জানতাম না ভাই বললো অনিকেত "
" না যদি সাথে স্বপ্ন হরিনী থাকে এমনিতেই সুর সৃষ্টি হয় বললো সৌরভ "
সবাই হেসে উঠল, লজ্জায় লাল হয়ে গেল দেবলীনার মুখ।
দেবলীনার মুখ চেয়ে স্মিতা বললো " আমার বান্ধবী কোন ফেলনা নয় বুঝলে দাদা "
" খুব ট্যালেন্টেড এরা দুজন, বললো অনিকেত। "
এবার কবিতাপাঠ করছে আমার আর একজন হবু ডাক্তার সৌরভদা , বললো স্মিতা ।"
" তব অন্তর্ধান পটে হরি তব রুপ চিরন্তন "
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার অন্তিম আগমন ।
লভিয়াছি চিরস্পর্শমনি ,
আমার শূন্যতা তুমি পূর্ণ করি গিয়েছ আপনি ।
জীবন আঁধার হল,সেই ক্ষনে পাইনু সন্ধান
সন্ধ্যায় দেউলদীপ চিত্তের মন্দিরে তব দান !
বিচ্ছেদের হোমবহি হতে
"পূজামুর্তি ধরি প্রেম দেখা দিল দুঃখের আলতে "
শেষের কবিতা থেকে আবৃতি করল সৌরভ
" আমার ছায়াতে তোমার হাসিতে "
মিলিত ছবি !
তাই নিয়ে আজি পরানে আমার
মেতেছে কবি ।
পদে পদে তব আলোর ঝলকে
ভাষা আনে প্রানে পলকে পলকে,
মোর বাণীরুপ দেখিলাম আজি
নিঝরিণী !
তোমার প্রবাহে মনেরে জাগাই
নিজেরে চিনি "
আবৃতি করল সুবর্ণ
"ও মাইন্ডব্লোয়িং দাদা এক কথায় অসাধারণ ,রবিঠাকুরের কবিতা তোমার কণ্ঠে বললো স্মিতা "
" কি ব্যাপার আমাদের বন্ধুকে নিরস ভাবতাম , একি রূপ তোর বললো অনিকেত "
" তোমাদের দুজনের জন্য প্রিয় কবিতা কিছু লাইন বললো স্মিতা"
রত্নমালা আনবি ঘরে
মাল্যবদল তখন হবে
পাতবি কি তোর দেবীর আসন
শূন্য ধুলায় পথের ধারে।
দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে রইল সুবর্ণ ও দেবলীনা
সবাই দুজনের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠল
" আবার হবে তো দেখা এই দেখাই শেষ দেখা নই তো গেয়ে উঠল সৌরভ "
মুচকি হাসলো সুবর্ণ , অন্য দিকে লজা পেয়ে গেল দেবলীনা
এমন সময় ড্রাইভার রতন এসে জানাল বাড়ি ফিরতে হবে বিকেলে বাবা, মা মাসিমনি, মেশোমশাই কোথায় যেন যাবেন "
তাই আজকে আড্ডা শেষ করে বেরিয়ে পড়লো সবাই।
রাত দুটো এখনো ঘুমাতে পারেনি সুবর্ণ ।কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে কথা-বার্তায় সেটাই মনে করতে পারছে না সুবর্ণ ।
এখন বুক জুড়ে অসম্ভব এক ভালো লাগা পাহাড়ি ঝরনার মতো তরতরিয়ে ছুটে চলছে ।যার কোন অন্ত নেই । স্কুল,কলেজ,এমনকি মেডিকেল কলেজে এত মেয়েদের সাথে মিশেছে কাউকে এত ভালো লাগেনি সুবর্ণের। ট্রেনে সেই অজানা মেয়েটিকে দেখার পর মনে হছিল একে যেন আমি যুগ যুগ ধরে চিনি , আমার প্রতিটি ভাবনাময় মুহুর্তে দেখছি অস্পষ্ট ছবি , সে যেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক মিলন ক্ষেত্রে ।
জানালার বাইরের আকাশটা দেখে সে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি প্রেমের পত্র বাহক।
তবে কি এই বর্ষায় সুবর্ণের বুকে গর্জন তুলল প্রেমের প্রবল আকুতি।চোখ বন্ধ করলে দেবলীনার মুখ,মায়াবী উজ্জ্বল চোখ সব ভেসে উঠছে নিমেষেই।
আর ভাবতে লাগলো আজকে সোনাঝুরিতে তাদের একসাথে গাওয়া গানের কথা।অনেকদিন পর গাইলো ও সুর ,তাল, ছন্দ কত সরলে গাওয়া গেল, কিন্তু একসাথে গাইলো ও গানটি সঠিক ব্যাখা পায়নি। এখন যেন একটু একটু করে পেতে লাগল । তার মনে হল জটিল অঙ্ক সমাধান করার জন্য যে ফর্মুলার দরকার হয় তার নাম অনুভূতি বোধ । আজ মনে আচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যেন দেবলীনাকে দেখেছেন । শুনেছেন সুবর্ণের মনের আকুলতা । এই গানের প্রতিটি স্বরলিপি সুবর্ণকে ভেবে লেখা । আজ সেই লাইন গুলো গাওয়ার সময় যেন দেবলীনা হৃদয়কে স্পর্শ করতে পেরেছে। সুরকার ও গায়ক এখন একাকার হয়ে এক সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলছে যার নাম সুবর্ণ ।
গুনগুন করে গাইতে লাগল সুবর্ণ "
"" এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
ভালোবাসি, ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,.
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির
জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে.
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে.
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী,
ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥"
ভালোবাসি
"ভালোবাসি, ভালোবাসি॥
কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম সত্যজিৎ রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মহান ব্যাক্তিত্বরা সাওতালি নাচ দেখতে ভালোবাসতেন ।সাওতালি মেয়েদের পায়ের গোছা দেখে কামনা জাগে । তারা চাপা চাপা লুকানো সত্যগুলো বলে উদাস হয় । আদিবাসীদের সরলতা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশিত । শোনা যায় উত্তরবঙ্গে সাওতালি মেয়েরা নিজেরাই স্বামী নির্ধারন করে । তারা তার পছন্দের পুরুষের সাথে মাস অথবা বছর এক সাথে থাকে যদি সেই সাওতাল মেয়েটির মনে হয় , তার পছন্দের পুরুষটি জীবন সঙ্গীর উপযুক্ত তাবে তাদের বিয়ে হয়, অথবা মেয়েটি ফিরে যায় নিজের বাবা,মার ঘরে । সকাল সকাল তিনজনে বেরিয়ে পড়ল ।আজ স্মিতার কোচিং থাকার জন্য সাথে নিতে পারলো না সুবর্ণ । কিছুদূর আসার পর দেবলীনাদের বাড়ি যাওয়ার গলির পথ খুঁজে পেল তিন জন। আমরা ভিনদেশী মানুষ দেখে তাদের মনে কৌতুহল হছে আমরা কি জন্য এসেছি, সরকারী লোক নাকি ।
সকালে সৌরভ যখন শুনেছে আমরা দেবলীনার বাড়ি যাবো আমাদের সাথে আসতে চায়নি। ওর খুব ভয় আদিবাসীরা রেগে গেলে বুকে তির মেরে দেয় । তাই চুপ করে আছে ও । অবশেষে দেবলীনার বাড়ির খোঁজ মিলল । বাড়িতে গিয়ে দেখলো দেবলীনার বাবা,মা ।আমরা স্মিতার আত্মীয় শুনে বাড়ির মেঝেতে বসতে দিল । আর জানালো দেবলীনা বাড়িতে নেই কেচিং এর জন্য বর্ধমানে গেছে ।
না না গল্পের মাঝে দেবলীনা স্বপ্নের কথা শোনালেন দেবলীনার বাবা-মায়ের কাছে । জীবনে খুব সংঘর্ষ করেছে দেবলীনা ।ছোট্টো থেকে খুব বুদ্ধিমান,খুব জেদি দেবলীনা ।লোকের বাড়িতে টিউশুনি করে, নিজের বাড়িতে টিউশুনি করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালায় । একমাত্র সন্তানের জন্য ওর বাবা রির্টায়ার্ড হবার পর সরকারী কোয়াটার ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে আছেন ।পরিস্কার ঘর, পাকা ইটের উপর টিনের ছাওনি । বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে, টিভি কিনেন নি মেয়ের জন্য যদি পড়াশোনার ক্ষতি হয় ।দেবলীনার মায়ের হাতে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল সবাই ।
" যাক প্রানে বাঁচলাম বললো সৌরভ "
" তোর জন্য আমাদের কী কী করতে হবে ,বললো অনিকেত "
" আমি একবার মামাবাড়িতে প্রেমে পড়েছিলাম ,মেয়েটির নাম ছিল অনুরিমা ,আমার কথাগুলো তার স্ববিরোধী মনে হত । আমি বলতাম শরীর, শরীরই, শরীরকে স্পর্শ করলে অপবিত্র হয়ে যায় না । ও পুরানো যুগের মেয়ের মতো পাপ,পূর্ণ বিশ্বাস করতো । ও বলতো ইন্টেলেকচুয়ালি কমিউনিটিতে কেউ বিশ্বাস নেই । বিয়ে না করলে মেয়েদের শরীরের হাত দেওয়ার অধিকার নেই পুরুষের । বিয়ের আগের সেক্স করা মানে পাপ করা মেয়েদের অসম্মান করা । আমরা দুজন , দুজনকে খুব ভালোবাসতাম ,একসাথে ঘুরে বেরাতাম , একসাথে একথালায় খেতাম , দুজন, দুজনকে একটু না দেখতে পেলে থাকতে পারতাম না । তার কিছুদিন পরে আমি পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়েছি শুনলাম আমাকে না জানিয়ে সরকারী বড় আমলার ছেলেকে বিয়ে করে এখন সুখে জীবন যাপন করছে । এখন আমাকে দেখলে আর চিনতে পারেনি । বললো সৌরভ"
" ঝুড়ি থেকে আস্তে আস্তে বিড়াল বেরিয়ে এল বলল অনিকেত "
"সুবর্ণকে দেখে পুরানো কিছু কথা মনে পড়ে গেল তাই বললো সৌরভ "
" তুই ও পাশ করার পর যদি তোদের বিয়ে না হয় এই আদিবাসী পাড়ার চেম্বার করিস ভাই বিয়ে না হোক দেখতে তো পাবি বললো অনিকেত "
নীরবে শুনছিল সুবর্ণ সারা রস্তায় একটিও কথা বলেনি ও। "
বাড়িতে ঢুকতেই, থমথমে পরিবেশ " তোমরা ফিরে গেছে , তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো ডিনার রেডি হয়ে গেছে বললো মাসিমা "
খারার টেবিলে বসল সবাই । সুবর্ণ দেখলো বাবা ও একজন মহিলার বসে আছেন । মোটাসোটা চেহারা, চোখে সুরু ফ্রেমের চশমা, হালকা নীল শাড়ি , খুব সুন্দরী দেখতে ।
" ইনি মিসেস গাঙ্গুলী, তোমার মায়ের বান্ধবী বললো বাবা"
খাবার টেবিল ছেড়ে পায়ে প্রণাম করতে গেল সুবর্ণ ,সাথে সৌরভ ও অনিকেত । " থাক থাক প্রণাম করতে হবে না বললো মিসেস গাঙ্গুলী "
যাক হাপ ছেড়ে বাঁচল সুবর্ণ ।
" এখনকার দিনে এত সংস্কারী ছেলে হয় না,এখনকার দিনে তোমাদের মতো হায়ার এডুকেটেড ছেলে, মেয়েরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লজ্জা পায় ।বিদেশে তো দেশীয় ছেলে, মেয়েরা সবাই হাত মেলায় । "
" আমি আমার ছেলেকে সব রকম শিক্ষা দিয়েছি মিসেস গাঙ্গুলী "
"ওই দুইজন ছেলেকে চিনতে পারলাম না "
" ওরা ছেলের বন্ধু ,একসাথে মেডিকেল কলেজে পড়ে।"
" আপনার ছেলে আমার বান্ধবীর মতো দেখতে হয়েছে ,মিস্টার রায়। "
" সেই জন্যই আমার দুঃচিন্তা মিসেস গাঙ্গুলী "
" কেন ? "
" আমি যা পচ্ছন্দ করিনা ও তাই করে।"
" সেকি বাবা, এনারা তোমাকে মানুষ করেছেন তাদের কে তুমি দুঃখ দিচ্ছ "
"পড়াশোনার বাইরে বন্ধুদের সাথে স্যোশাল ওয়াক করি , সেটা বাবার অপছন্দ "
" তবুও তোমার বাবা, মার সম্মান , আভিজাত্য, তাদের কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে, তাছাড়া এই সব করার জন্য অনেক লোক আছে। "
" ওকে কিছু বলবেন না মিসেস গাঙ্গুলী ।""
"এম, বি, এস পাশ করার পর তোমার কি ইচ্ছে আছে, বিদেশে যাবে নাকি ভালো নাসিংহোমে প্যাকটিশ করবে। "
" আমার ইচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা, যারা বিনা চিকিৎসাতে মারা যাচ্ছে তাদের জন্য,প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে মানুষ চিকিৎসা পায় না আমি তাদের নিয়ে কিছু করবো । "
" শুনলেন মিসেস গাঙ্গুলী ছেলের কথা শুনলেন "
" আপনি উত্তেজিত হবেন না । উত্তেজিত হলে আপনারা শরীর খারাপ হবে মিস্টার রায়"
" এই ছেলেকে নিয়ে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা "
"এখন ছেলে বড় হয়েছে , এটা তোদের উপর ছেড়ে দিন মিস্টার রায়, । "
পিতৃদেব ঝাঁকুনি দিয়ে মুখ ফেরালেন ।
" যাই বলুন, আপনি বড্ড রাগী ।"
" মোটেই না কলেজের ছেলে, মেয়েরা আমাকে খুব পচ্ছন্দ করে ,ভালোবাসে আপনার বান্ধবীর কাছে শুনেনিন । "
এমন সময় খাবার. টেবিলে এসে পৌচ্ছালো , সবাই মাথা নিচু করে খেতে লাগলো ।
এমন সময় বাবা জানালেন- কালকে তোমরা তিনজন সাথে স্মিতাকে নিয়ে বিকালে যাও মিসেস গাঙ্গুলীর বাড়ি।
" হে বাবা এসো তোমরা , আমরা মেয়ে বিদেশ থেকে এখানে এসে বড্ড একা হয়ে পড়েছে , তোমরা এলে ওর ভালো লাগবে "
খাওয়া শেষ করে তিনজন নিজের রুমে চলে এল ।
এমন সময় অনিকেত বললো" তুই মিসেস গাঙ্গুলীর মেয়েকে দেখেছিস "
" দূর এর আগে মায়ের এই বান্ধবীকে কোন দিন দেখিনি। "
" মনে হয় খুব কিউট হবে , মাকে দেখেই মেয়ের ছবি ভেসে উঠেছে বললো সৌরভ "
"বিয়ে করবি! কথা বলবো ? মিসেস গাঙ্গুলীর সাথে বললো সুবর্ণ "
" প্লিজ এই হেল্পটা কর ভাই বছরে একবার তোর সাথে মানুষের সেবা করবো বললো সৌরভ "
" এর ফাঁকে মিসেস গাঙ্গুলী তোকে তার মেয়েকে পছন্দ করতে নিয়ে যাচ্ছে না তো ? বললো অনিকেত "
" কী ভাবে বুঝলি ! "
" না দেখে মনে হলো, তোকে যেভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করছিল মনে হচ্ছে অন্য পরিকল্পনা আছে। "
" দাঁড়া মায়ের কাছে জানাতে হবে। "
এমন সময় স্মিতা এসে সামনে দাঁড়ালো
কিছু বলবি - বললো সুবর্ণ ? "
" তোমরা কী জন্য দেবলীনার পাড়ায় গিয়েছিলে ? "
" এমনি গিয়েছিলাম ,তাতে কি হয়েছে বললো সুবর্ণ ।"
" তুমি জানো না দাদা আদিবাসীদের অনেক নিয়ম আছে,এইভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি তোমাদের। "
" না আমরা আদিবাসী গ্রামের সামনে নদী সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম বললো অনিকেত। "
" দেবলীনা খুব কাঁদছিল দাদা , বাড়ি এসে আমাকে ফোন করেছিল "
" তুই ওকে কিছু বলিসনি "
" ও খুব শান্ত দাদা, খুব আত্মসম্মানি , অনেক বুঝিয়েছি ! তোমার সাথে কালকে একবার দেখা করতে চায় । সকাল নয়টাই কোপাই নদীর তীরে । "
" এখন মাথায় টেনশন কমলো সুবর্ণের "
ড্রাইভার রতনকে নিল স্মিতা ,মেশেমোশাই বারবার বলেদিয়েছেন স্মিতা যেন ড্রাইভিং না করে দেখো তোমরা । বোলপুরের আবহাওয়া আজ খুব ভালো মেঘলা নেই হালকা রোদ উঠেছে ।গাড়ি কিছু দূর যেতেই সামনের মোড়ে গলির সামনে দাঁড়িয়ে গেল । ঘড়িতে তখন পৌনে দশটা চিন্তায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো সুবর্ণের । দেবলীনা কি আর আসবে না ? নাকি কালকের ঘটনার জন্য আসতে দ্বিধাবোধ করছে ?
হঠাৎ গাড়ির জানালার ফাঁকা দিয়ে সামনের গলির দিকে লক্ষ্য গেল সুবর্ণের দেখলো লাল রঙের শাড়ি পরে দূত আসছে দেবলীনা। রোগা পাতলা চেহারা শ্যামল বর্ণ গায়ের রঙ কপালে লাল টিপ ,সামনে আসতেই হালকা হাসলো দেবলীনা ।
" কিরে এত লেট বললো স্মিতা "
" আজ টিউশুনি অফ করেদিয়েছিলাম যেই রেডি হয়ে বেরুবো অমনি বাবার শরীরটা খারাপ হলো তাই একটু লেট বললো দেবলীনা "
"আচ্ছা উঠে আয় বললো স্মিতা"
গাড়ি চলতে লাগলো, গাড়ির মধ্যে হাসি, ঠাট্টাতে চলতে লাগলো ক্লান্তি হীন যাত্রা,বোলপুর শহর থেকে সামনেই রবিঠাকুরের বিশ্বভারতী, এতদিন পাঠ্যবই এ পড়েছে,কিন্তু কোন দিন দেখার সুযোগ হয়নি। অগনিত পথ যাত্রীর ভিড় শান্তিনিকেতনের রাস্তায় , বেশিরভাগ টুরিস্ট, ড্রাইভার রতন বিশ্বভারতীর সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো।বিশ্বভারতীর প্রবেশ করল সবাই । একের পর এক ভবন ঘুরে দেখতে লাগলো সবাই । রামকিঙ্কর বেইজের শিল্প, কলাভবনের প্রতোক ছবি এক কথায অসাধারণ । নন্দলালের ছবি, নিখুঁত ভাবে দেখতে লাগলো সবাই । এত হাঁটাহাঁটি জন্য খুব ক্লান্ত লাগছি সুবর্ণকে । এইভাবে কোনদিন হাঁটেনি ও । তাই দেখে দেবলীনাকে, স্মিতা বললো "তোরা দুজনে একটু রেস্ট নে কোথাও । এই ভাবে দুজন আম্রকুঞ্জে গিয়ে বাঁধানে গাছের তলায় বসল । সারি সারি ছেলে মেয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে সবার পরনে পাঞ্জাবী, মেয়েদের বেশীর ভাগ শাড়ি পড়েছে । এই আম্রকুঞ্জে যুগলের ভিড় বেশী।
প্রান্তিক সমাহার বৈচিত্র্যময় ভাবনা প্রত্যেক মানুষের, এই ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছে ওরা,যারা ভালোবাসে, ভালোবাসে তাদের প্রিয় কবিকে,ভালোবাসে শান্তিনিকেতনের প্রত্যেক স্মৃতিচারণে,
"আপনার কবিতা ভালো লাগে , অবশেষে প্রথম কথা বললো দেবলীনা।"
ইতস্তত হয়ে উত্তর দিল সুবর্ণ " না সেই ভাবে কোনদিন পড়া হয়নি "
"কিন্তু রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ, সুভাস মুখোপাধ্যায়দের যে কোন ও বাঙালীর নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য পড়া উচিত । এই গুলো না পড়লে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় ।"
পড়েনি বলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। কী করে বলি বাড়িতে বইয়ের লাইব্রেরী আছে, বাবা- মা দুজনে পড়েতে ভালোবাসেন। কিন্তু স্কুল জীবনে ক্লাসের বই ,কলেজ এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে কবিতা
পড়ার সুযোগ পাইনি ।
" স্মিতার কাছে শুনেছি আপনি ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন ।"
" না সেই ভাবে পারিনা ছোটো বেলায় মায়ের কাছে শিখেছিলাম। "
স্মিতা ও বলছিল আপনিও ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন এবং ভালো কবিতা আবৃতি করতে পারেন , তা রবিঠাকুরের কাছে এসে বঞ্চিত হব "
" না না ও মিথ্যে বলেছে তেমন ভাবে ভালো পারিনা "
"ভালো হোক বা খারাপ শ্রোতা বিচার করবে"
" তবুও শ্রুতিমধুর না হলে শ্রোতার অভিব্যক্তি খারাপ হয়"
" শ্রোতা যদি অনভিজ্ঞ হয় তবে খারাপ ও শ্রুতিমধুর ''
এমন সময় স্মিতা , সৌরভ, অনিকেত ফিরল।
"চলো সামনে সোনাঝুরি ওইখানে গিয়ে বসি, বললো স্মিতা"
একটু হাঁটা পথ সোনাঝুরি,ওখানে হাট বসে , যুগলদের নির্জন স্থান।
সবাই বসে পড়ল ,এখন সময় স্মিতা বললো একটা গান কর দেবলীনা,
আজকের দিনটা স্বরণীয় হয়ে থাক , জানিনা ভবিষ্যতে আমরা কোথায় কে থাকবে "
অনেক আপত্তি করল দেবলীনা , এমন সময় সুবর্ণ বললো আপনি শুরু করুন আমি আপনার সঙ্গ দিতে পারি "
" এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
ভালোবাসি, ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,.
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির
জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে.
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে.
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী,
ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥"
ভালোবাসি
"ভালোবাসি, ভালোবাসি॥
সবাই একত্রে হাত তালি দিয়ে উঠল
"অসাধারণ গেয়েছিস দেবলীনা, বললো স্মিতা "
" তুই ও এত ভালো গাইতে পারিস জানতাম না ভাই বললো অনিকেত "
" না যদি সাথে স্বপ্ন হরিনী থাকে এমনিতেই সুর সৃষ্টি হয় বললো সৌরভ "
সবাই হেসে উঠল, লজ্জায় লাল হয়ে গেল দেবলীনার মুখ।
দেবলীনার মুখ চেয়ে স্মিতা বললো " আমার বান্ধবী কোন ফেলনা নয় বুঝলে দাদা "
" খুব ট্যালেন্টেড এরা দুজন, বললো অনিকেত। "
এবার কবিতাপাঠ করছে আমার আর একজন হবু ডাক্তার সৌরভদা , বললো স্মিতা ।"
" তব অন্তর্ধান পটে হরি তব রুপ চিরন্তন "
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার অন্তিম আগমন ।
লভিয়াছি চিরস্পর্শমনি ,
আমার শূন্যতা তুমি পূর্ণ করি গিয়েছ আপনি ।
জীবন আঁধার হল,সেই ক্ষনে পাইনু সন্ধান
সন্ধ্যায় দেউলদীপ চিত্তের মন্দিরে তব দান !
বিচ্ছেদের হোমবহি হতে
"পূজামুর্তি ধরি প্রেম দেখা দিল দুঃখের আলতে "
শেষের কবিতা থেকে আবৃতি করল সৌরভ
" আমার ছায়াতে তোমার হাসিতে "
মিলিত ছবি !
তাই নিয়ে আজি পরানে আমার
মেতেছে কবি ।
পদে পদে তব আলোর ঝলকে
ভাষা আনে প্রানে পলকে পলকে,
মোর বাণীরুপ দেখিলাম আজি
নিঝরিণী !
তোমার প্রবাহে মনেরে জাগাই
নিজেরে চিনি "
আবৃতি করল সুবর্ণ
"ও মাইন্ডব্লোয়িং দাদা এক কথায় অসাধারণ ,রবিঠাকুরের কবিতা তোমার কণ্ঠে বললো স্মিতা "
" কি ব্যাপার আমাদের বন্ধুকে নিরস ভাবতাম , একি রূপ তোর বললো অনিকেত "
" তোমাদের দুজনের জন্য প্রিয় কবিতা কিছু লাইন বললো স্মিতা"
রত্নমালা আনবি ঘরে
মাল্যবদল তখন হবে
পাতবি কি তোর দেবীর আসন
শূন্য ধুলায় পথের ধারে।
দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে রইল সুবর্ণ ও দেবলীনা
সবাই দুজনের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠল
" আবার হবে তো দেখা এই দেখাই শেষ দেখা নই তো গেয়ে উঠল সৌরভ "
মুচকি হাসলো সুবর্ণ , অন্য দিকে লজা পেয়ে গেল দেবলীনা
এমন সময় ড্রাইভার রতন এসে জানাল বাড়ি ফিরতে হবে বিকেলে বাবা, মা মাসিমনি, মেশোমশাই কোথায় যেন যাবেন "
তাই আজকে আড্ডা শেষ করে বেরিয়ে পড়লো সবাই।
রাত দুটো এখনো ঘুমাতে পারেনি সুবর্ণ ।কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে কথা-বার্তায় সেটাই মনে করতে পারছে না সুবর্ণ ।
এখন বুক জুড়ে অসম্ভব এক ভালো লাগা পাহাড়ি ঝরনার মতো তরতরিয়ে ছুটে চলছে ।যার কোন অন্ত নেই । স্কুল,কলেজ,এমনকি মেডিকেল কলেজে এত মেয়েদের সাথে মিশেছে কাউকে এত ভালো লাগেনি সুবর্ণের। ট্রেনে সেই অজানা মেয়েটিকে দেখার পর মনে হছিল একে যেন আমি যুগ যুগ ধরে চিনি , আমার প্রতিটি ভাবনাময় মুহুর্তে দেখছি অস্পষ্ট ছবি , সে যেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক মিলন ক্ষেত্রে ।
জানালার বাইরের আকাশটা দেখে সে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি প্রেমের পত্র বাহক।
তবে কি এই বর্ষায় সুবর্ণের বুকে গর্জন তুলল প্রেমের প্রবল আকুতি।চোখ বন্ধ করলে দেবলীনার মুখ,মায়াবী উজ্জ্বল চোখ সব ভেসে উঠছে নিমেষেই।
আর ভাবতে লাগলো আজকে সোনাঝুরিতে তাদের একসাথে গাওয়া গানের কথা।অনেকদিন পর গাইলো ও সুর ,তাল, ছন্দ কত সরলে গাওয়া গেল, কিন্তু একসাথে গাইলো ও গানটি সঠিক ব্যাখা পায়নি। এখন যেন একটু একটু করে পেতে লাগল । তার মনে হল জটিল অঙ্ক সমাধান করার জন্য যে ফর্মুলার দরকার হয় তার নাম অনুভূতি বোধ । আজ মনে আচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যেন দেবলীনাকে দেখেছেন । শুনেছেন সুবর্ণের মনের আকুলতা । এই গানের প্রতিটি স্বরলিপি সুবর্ণকে ভেবে লেখা । আজ সেই লাইন গুলো গাওয়ার সময় যেন দেবলীনা হৃদয়কে স্পর্শ করতে পেরেছে। সুরকার ও গায়ক এখন একাকার হয়ে এক সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলছে যার নাম সুবর্ণ ।
গুনগুন করে গাইতে লাগল সুবর্ণ "
"" এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
ভালোবাসি, ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,.
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির
জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে.
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে.
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী,
ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥"
ভালোবাসি
"ভালোবাসি, ভালোবাসি॥
কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম সত্যজিৎ রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মহান ব্যাক্তিত্বরা সাওতালি নাচ দেখতে ভালোবাসতেন ।সাওতালি মেয়েদের পায়ের গোছা দেখে কামনা জাগে । তারা চাপা চাপা লুকানো সত্যগুলো বলে উদাস হয় । আদিবাসীদের সরলতা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশিত । শোনা যায় উত্তরবঙ্গে সাওতালি মেয়েরা নিজেরাই স্বামী নির্ধারন করে । তারা তার পছন্দের পুরুষের সাথে মাস অথবা বছর এক সাথে থাকে যদি সেই সাওতাল মেয়েটির মনে হয় , তার পছন্দের পুরুষটি জীবন সঙ্গীর উপযুক্ত তাবে তাদের বিয়ে হয়, অথবা মেয়েটি ফিরে যায় নিজের বাবা,মার ঘরে । সকাল সকাল তিনজনে বেরিয়ে পড়ল ।আজ স্মিতার কোচিং থাকার জন্য সাথে নিতে পারলো না সুবর্ণ । কিছুদূর আসার পর দেবলীনাদের বাড়ি যাওয়ার গলির পথ খুঁজে পেল তিন জন। আমরা ভিনদেশী মানুষ দেখে তাদের মনে কৌতুহল হছে আমরা কি জন্য এসেছি, সরকারী লোক নাকি ।
সকালে সৌরভ যখন শুনেছে আমরা দেবলীনার বাড়ি যাবো আমাদের সাথে আসতে চায়নি। ওর খুব ভয় আদিবাসীরা রেগে গেলে বুকে তির মেরে দেয় । তাই চুপ করে আছে ও । অবশেষে দেবলীনার বাড়ির খোঁজ মিলল । বাড়িতে গিয়ে দেখলো দেবলীনার বাবা,মা ।আমরা স্মিতার আত্মীয় শুনে বাড়ির মেঝেতে বসতে দিল । আর জানালো দেবলীনা বাড়িতে নেই কেচিং এর জন্য বর্ধমানে গেছে ।
না না গল্পের মাঝে দেবলীনা স্বপ্নের কথা শোনালেন দেবলীনার বাবা-মায়ের কাছে । জীবনে খুব সংঘর্ষ করেছে দেবলীনা ।ছোট্টো থেকে খুব বুদ্ধিমান,খুব জেদি দেবলীনা ।লোকের বাড়িতে টিউশুনি করে, নিজের বাড়িতে টিউশুনি করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালায় । একমাত্র সন্তানের জন্য ওর বাবা রির্টায়ার্ড হবার পর সরকারী কোয়াটার ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে আছেন ।পরিস্কার ঘর, পাকা ইটের উপর টিনের ছাওনি । বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে, টিভি কিনেন নি মেয়ের জন্য যদি পড়াশোনার ক্ষতি হয় ।দেবলীনার মায়ের হাতে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল সবাই ।
" যাক প্রানে বাঁচলাম বললো সৌরভ "
" তোর জন্য আমাদের কী কী করতে হবে ,বললো অনিকেত "
" আমি একবার মামাবাড়িতে প্রেমে পড়েছিলাম ,মেয়েটির নাম ছিল অনুরিমা ,আমার কথাগুলো তার স্ববিরোধী মনে হত । আমি বলতাম শরীর, শরীরই, শরীরকে স্পর্শ করলে অপবিত্র হয়ে যায় না । ও পুরানো যুগের মেয়ের মতো পাপ,পূর্ণ বিশ্বাস করতো । ও বলতো ইন্টেলেকচুয়ালি কমিউনিটিতে কেউ বিশ্বাস নেই । বিয়ে না করলে মেয়েদের শরীরের হাত দেওয়ার অধিকার নেই পুরুষের । বিয়ের আগের সেক্স করা মানে পাপ করা মেয়েদের অসম্মান করা । আমরা দুজন , দুজনকে খুব ভালোবাসতাম ,একসাথে ঘুরে বেরাতাম , একসাথে একথালায় খেতাম , দুজন, দুজনকে একটু না দেখতে পেলে থাকতে পারতাম না । তার কিছুদিন পরে আমি পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়েছি শুনলাম আমাকে না জানিয়ে সরকারী বড় আমলার ছেলেকে বিয়ে করে এখন সুখে জীবন যাপন করছে । এখন আমাকে দেখলে আর চিনতে পারেনি । বললো সৌরভ"
" ঝুড়ি থেকে আস্তে আস্তে বিড়াল বেরিয়ে এল বলল অনিকেত "
"সুবর্ণকে দেখে পুরানো কিছু কথা মনে পড়ে গেল তাই বললো সৌরভ "
" তুই ও পাশ করার পর যদি তোদের বিয়ে না হয় এই আদিবাসী পাড়ার চেম্বার করিস ভাই বিয়ে না হোক দেখতে তো পাবি বললো অনিকেত "
নীরবে শুনছিল সুবর্ণ সারা রস্তায় একটিও কথা বলেনি ও। "
বাড়িতে ঢুকতেই, থমথমে পরিবেশ " তোমরা ফিরে গেছে , তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো ডিনার রেডি হয়ে গেছে বললো মাসিমা "
খারার টেবিলে বসল সবাই । সুবর্ণ দেখলো বাবা ও একজন মহিলার বসে আছেন । মোটাসোটা চেহারা, চোখে সুরু ফ্রেমের চশমা, হালকা নীল শাড়ি , খুব সুন্দরী দেখতে ।
" ইনি মিসেস গাঙ্গুলী, তোমার মায়ের বান্ধবী বললো বাবা"
খাবার টেবিল ছেড়ে পায়ে প্রণাম করতে গেল সুবর্ণ ,সাথে সৌরভ ও অনিকেত । " থাক থাক প্রণাম করতে হবে না বললো মিসেস গাঙ্গুলী "
যাক হাপ ছেড়ে বাঁচল সুবর্ণ ।
" এখনকার দিনে এত সংস্কারী ছেলে হয় না,এখনকার দিনে তোমাদের মতো হায়ার এডুকেটেড ছেলে, মেয়েরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে লজ্জা পায় ।বিদেশে তো দেশীয় ছেলে, মেয়েরা সবাই হাত মেলায় । "
" আমি আমার ছেলেকে সব রকম শিক্ষা দিয়েছি মিসেস গাঙ্গুলী "
"ওই দুইজন ছেলেকে চিনতে পারলাম না "
" ওরা ছেলের বন্ধু ,একসাথে মেডিকেল কলেজে পড়ে।"
" আপনার ছেলে আমার বান্ধবীর মতো দেখতে হয়েছে ,মিস্টার রায়। "
" সেই জন্যই আমার দুঃচিন্তা মিসেস গাঙ্গুলী "
" কেন ? "
" আমি যা পচ্ছন্দ করিনা ও তাই করে।"
" সেকি বাবা, এনারা তোমাকে মানুষ করেছেন তাদের কে তুমি দুঃখ দিচ্ছ "
"পড়াশোনার বাইরে বন্ধুদের সাথে স্যোশাল ওয়াক করি , সেটা বাবার অপছন্দ "
" তবুও তোমার বাবা, মার সম্মান , আভিজাত্য, তাদের কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে, তাছাড়া এই সব করার জন্য অনেক লোক আছে। "
" ওকে কিছু বলবেন না মিসেস গাঙ্গুলী ।""
"এম, বি, এস পাশ করার পর তোমার কি ইচ্ছে আছে, বিদেশে যাবে নাকি ভালো নাসিংহোমে প্যাকটিশ করবে। "
" আমার ইচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা, যারা বিনা চিকিৎসাতে মারা যাচ্ছে তাদের জন্য,প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে মানুষ চিকিৎসা পায় না আমি তাদের নিয়ে কিছু করবো । "
" শুনলেন মিসেস গাঙ্গুলী ছেলের কথা শুনলেন "
" আপনি উত্তেজিত হবেন না । উত্তেজিত হলে আপনারা শরীর খারাপ হবে মিস্টার রায়"
" এই ছেলেকে নিয়ে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা "
"এখন ছেলে বড় হয়েছে , এটা তোদের উপর ছেড়ে দিন মিস্টার রায়, । "
পিতৃদেব ঝাঁকুনি দিয়ে মুখ ফেরালেন ।
" যাই বলুন, আপনি বড্ড রাগী ।"
" মোটেই না কলেজের ছেলে, মেয়েরা আমাকে খুব পচ্ছন্দ করে ,ভালোবাসে আপনার বান্ধবীর কাছে শুনেনিন । "
এমন সময় খাবার. টেবিলে এসে পৌচ্ছালো , সবাই মাথা নিচু করে খেতে লাগলো ।
এমন সময় বাবা জানালেন- কালকে তোমরা তিনজন সাথে স্মিতাকে নিয়ে বিকালে যাও মিসেস গাঙ্গুলীর বাড়ি।
" হে বাবা এসো তোমরা , আমরা মেয়ে বিদেশ থেকে এখানে এসে বড্ড একা হয়ে পড়েছে , তোমরা এলে ওর ভালো লাগবে "
খাওয়া শেষ করে তিনজন নিজের রুমে চলে এল ।
এমন সময় অনিকেত বললো" তুই মিসেস গাঙ্গুলীর মেয়েকে দেখেছিস "
" দূর এর আগে মায়ের এই বান্ধবীকে কোন দিন দেখিনি। "
" মনে হয় খুব কিউট হবে , মাকে দেখেই মেয়ের ছবি ভেসে উঠেছে বললো সৌরভ "
"বিয়ে করবি! কথা বলবো ? মিসেস গাঙ্গুলীর সাথে বললো সুবর্ণ "
" প্লিজ এই হেল্পটা কর ভাই বছরে একবার তোর সাথে মানুষের সেবা করবো বললো সৌরভ "
" এর ফাঁকে মিসেস গাঙ্গুলী তোকে তার মেয়েকে পছন্দ করতে নিয়ে যাচ্ছে না তো ? বললো অনিকেত "
" কী ভাবে বুঝলি ! "
" না দেখে মনে হলো, তোকে যেভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করছিল মনে হচ্ছে অন্য পরিকল্পনা আছে। "
" দাঁড়া মায়ের কাছে জানাতে হবে। "
এমন সময় স্মিতা এসে সামনে দাঁড়ালো
কিছু বলবি - বললো সুবর্ণ ? "
" তোমরা কী জন্য দেবলীনার পাড়ায় গিয়েছিলে ? "
" এমনি গিয়েছিলাম ,তাতে কি হয়েছে বললো সুবর্ণ ।"
" তুমি জানো না দাদা আদিবাসীদের অনেক নিয়ম আছে,এইভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি তোমাদের। "
" না আমরা আদিবাসী গ্রামের সামনে নদী সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম বললো অনিকেত। "
" দেবলীনা খুব কাঁদছিল দাদা , বাড়ি এসে আমাকে ফোন করেছিল "
" তুই ওকে কিছু বলিসনি "
" ও খুব শান্ত দাদা, খুব আত্মসম্মানি , অনেক বুঝিয়েছি ! তোমার সাথে কালকে একবার দেখা করতে চায় । সকাল নয়টাই কোপাই নদীর তীরে । "
" এখন মাথায় টেনশন কমলো সুবর্ণের "
*চলবে...
চলুক
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনসাবলীল গতিতে কাহিনি এগিয়ে যাচ্ছে।চলুক।কৌতূহলও থাকুক।
উত্তরমুছুন