Web ডুয়ার্স- এর নিবেদন।           

ধারাবাহিক উপন্যাস 



                          বেলাভূমি

       লেখক -  জিৎ পাত্র 




(প্রথম ) 
জিৎ পাত্র

বাঁকুড়া জেলা ও পুরুলিয়া জেলার মধ্যবর্তী সীমান্তের ,প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়ের কোলে আদিবাসী গ্রাম মুকুন্দপুর। বিস্তীর্ন  এলাকা শাল, মহুমার জঙ্গলে ঘেরা । রাঙ্গামাটির পথ সারি সারি পলাশ ,কৃষ্ণচূড়া। মাটির বাড়ি দেয়ালে রংবেরঙের আলপনা আঁকা । পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অপরূপা কুমারী নদী । চারদিকে ভালোবাসার আবেশ,মারাং বুরুর আশীর্বাদে ফুলে ফেঁপে উঠছে চাষির সোনার ফসল।
এই গ্রামেই থাকেন ডাক্তার সুবর্ণ রায়।আদি নিবাস কলকাতা এম,বি,বি,এস পাশ করার পর  সরকারী চাকুরী নিয়ে আসেন মুকুন্দপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে । দেখছেন এলাকার মানুষের অভাব ,অনটন ও জীবন সংগ্রামের কথা । দেখেছেন বিনা চিকিৎসায় অসহায় মানুষের মৃত্যু । এই মানুষগুলোর ভালোবাসার টানে রয়ে গেলেন অবসর জীবনের পরেও । বাবা, মারা যাবার পর পৈত্রিক সম্পত্তি দান করে দিয়েছেন একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে । প্রথম চাকুরী জীবনে পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো হসপিটালের সরকারি কোয়ার্টারে মাকে নিয়ে ছিলেন . তিনিও গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে । রিটায়ার হবার পর এখন বাড়ি বানিয়েছেন মুকুন্দপুর গ্রামে ।
এখন বাড়িতেই তার চেম্বার । একদিন রুগী দেখার পর চেম্বারে একাই বসে আছেন । বর্ষাকাল মেঘলা আকাশ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি । নিজের খেয়ালে তিনি লিখেছেন ...

বর্ষার আগমনটাই এক আর্শীবাদের উচ্ছ্বসিত উচ্চারণে
তাই সামগ্রিক ভাবে তাকে কোনো মাপকাঠিতে ধরতে চাইনা ।কারণ এই আশা প্রতিটি মানুষের পুষে রাখা স্বপ্ন সম্বলের বিশল্যকরণী । এগিয়ে যাওয়ার দিশা, জীবনের অস্তিত্বের নিরুচ্চারিত অথচ পূর্ণতা প্রাপ্তির এক অমোঘ মন্ত্র ।যে বর্ষা আমাদের প্রকৃতিতে , সেই বর্ষা আমাদের মনে -পাওয়া না পাওয়ার অনুযোগ - অভিযোগ ও আন্তরিকতার এক স্বকীয় সময় । প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির ,সুখ- দুঃখ এই সবের হিসেব জানিনা ,কিন্তু এই সব কিছু মিশেও এক সর্ম্পূণতার দাবী যেন ছিল এই বর্ষার সম্ভবে । পূর্ণতা হয়তো দিতে পারিনি । কিন্তু সব প্রাপ্তি যেমন সুখের হয় না ,তেমনি সব অপ্রাপ্তি ও দুঃখের নয় ।তার গড়ে ওঠার ছন্দ টাও খানিক পিচ্ছিল ভেজা পথে সাবধানী চলন ভঙ্গিতে । কিছু বা বানভাসী রাস্তায় থমকে যাওয়ার মন খারাপে। আবার কখনো নিজের মতো পথ র্নিমানে সহজ স্বাভাবিক স্বভাবে । এই মরশুমের শেষ বর্ষা ফেলার সাথে সাথে কিঞ্চিত অতীত যাপনকেও মনে করে দিতে দ্বিধা বোধ করেনি । বর্ষা আমার পুরানো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় যে ভাবে বানভাসি মানুষের সব কিছু কেড়ে নেই ।মাঝে মাঝে জীবনের শেষ লগ্নে একাকীত্বের বেড়া থেকে বেড়িয়ে আসতে খোঁজে মন । ক্ষতবিক্ষত যন্ত্রনা গুলো বিদ্রোহ করে, অযাচিত কিছু সম্পর্কের মায়ারবাঁধনে চোখের পাতায় নামে শ্রাবণ। ইতি মধ্যে কম্পাউন্ডার রতন এসে জানায় ব্লকের বিডিও ম্যাডাম এসেছেন। আপনার সাথে একবার দেখা করতে চান ।
রতনকে ভিতরে নিয়ে আসতে বলেন সুবর্ণ ।


" কেমন আছো সুবর্ণ ? "
"তুমি ! "
"হ্যাঁ আমি দেবলীনা হেব্রম , বিডিও মধুপুর " ।.
"আমি বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা ! তোমার সাথে কোন ও দিন দেখা হবে । আজ সেই তুমি কত বদলে গেছো ! "
"পৃথিবীটা গোল সুবর্ণ !একদিন না একদিন দেখা আমাদের হতেই, মৃত্যুর আগে অবধি " ।.
"প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল ! তাই না দেবলীনা ? "
" হ্যাঁ তা তো হলো । "
"কত বদলে গেছ তুমি ! কিন্তু দেখে অবাক লাগে সেই শান্ত , লাজুক,লড়াকু মেয়েটি আজ একজন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক । "
" সময় সব কিছুই বদলে দেয় সুবর্ণ "
"সময় ! "
"কেমন আছো সুবর্ণ ? "
" দেখছো না এই বৃষ্টির মাঝে পুরনো স্মৃতি আর এই মুকুন্দপুরের প্রত্যেক মানুষের মায়াবাধনে আবদ্ধ হয়ে ভালোই আছি,যখন নিঃসঙ্গ মনে হয় সামনে কুমারী নদীর ঘটে গিয়ে বসি। "
"তারপর । "
"নদীর পাড়ে পাখীর গান ও নদীর জলজ প্রানী আমার সাথে কথা বলে,তবুও ফেলে আসা দিনের দগ্ধতার যন্ত্রনায় ছটপট করতে থাকি, সব শেষে এক পশলা বৃষ্টি সব ম্লান করে দেয়। "
"চুপ করো প্লিজ চুপ করো সুবর্ণ ,এই আবেগ আর মানায় না তোমার ,
কত বড়ো ডাক্তার তুমি ,সারা মধুপুর ব্লকের সমস্ত আদিবাসী মানুষ তোমাকে দেবজ্ঞানে পূজো করে,আর তাদের ভগবানের চোখে জল। "
"এই অশ্রু আনন্দের, বিরহ আমাকে আর কাঁদায় না
দেবলীনা। "
"বিয়ে কোন করোনি সুবর্ণ ? "
"যদি বলি অপেক্ষার, অপেক্ষায় ছিলাম। "
"কিন্তু তোমার বাবা,মা - র ইচ্ছে ? "
"সব বাবা, মা-র ইচ্ছে পূরণ হয় না দেবলীনা "
"এক আকাশ অভিমান নিয়ে তিরিশ বছর অপেক্ষা করে আমাকে অপরাধী করলে সুবর্ণ ? তুমিতো জানতে দেবলীনারা অপেক্ষায় থাকে না ,তারা স্বার্থপর ! "
" আজ ও ফেলে আসা দিনের কথা খুব মনে পড়ে দেবলীনা ! আমাদের কয়েকদিনের সম্পর্ক ,আমাদের ভালোবাসা , একসাথে সারাজীবন চলার সেই দৃঢ় সংকল্প । কিন্তু দেখো আজ সব কিছুই চলমান শুধু আমরা বদলে গেছি ।"
" আমার কোন দোষ ছিল না সুবর্ণ , আমার সাথে ,আমার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যই আমাদের সেই দিন ভোরে বীরভুম ছাড়তে বাধ্য করে ছিল , অপমানের হাত থেকে বাঁচতে চোরের মতো কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম দেশের বাড়ি "
" তোমাকে অনেক কিছুই বলার ছিল দেবলীনা কিন্তু সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে ,তবু জেনে রেখো কত খুঁজেছি তোমাদের তন্ন তন্ন করে বীরভুম শহরের প্রতিটি গলি ,রাস্তা, তোমার পরিচিতদের বাড়ি , তোমার কোচিং ক্লাস , তোমার টিউশুনির পড়ানো ছাত্র- ছাত্রীর বাড়িতে , । কিন্তু নিরাশা ছাড়া কিছুই পাইনি ।
" আমার সেই সময় মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না সুবর্ণ , চারদিকে আতঙ্ক তোমার বাবার পাঠানো গুন্ডাবাহিনীর হুশিয়ারী পরিবার হারনো ভয় তাড়া করছিল । ইচ্ছে ছিল শেষ বারের মতো তোমায় চিঠি পাঠাই , কিন্তু বাবার রক্তাক্ত মুখটা ভেসে আসছিল কাগজের পাতায় আর চিঠি লেখার সাহস পাইনি। "
" আমাকে সেই সময় কিছুই জানানো হয়নি দেবলীনা "
" জানালে তুমি কি করতে । "
" ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে এই ভাবে নিঃসঙ্গ হতে হতো না। "
" গরীবের ভালোবাসা, যেখানে জাতি ধর্মের বিভেদ সেইখানে ভালোবাসা ও গুমরে মরে "
"ভালোবাসায় বৈষম্যের ইয়ত্তা করে না দেবলীনা "
"কিন্তু তুমি কি পারতে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে"
" তোমাকে পালিয়ে যেতে দিতাম না"
"কিছু জানানো না তুমি সুবর্ণ"
" পরে মাসতোতো বোনের কাছে কিছু ঘটনা শুনেছিলাম , নিজেকে বড় অপরাধী লাগছিল, ক্ষমা
করতে পারিনি তোমার উপর অত্যাচারিত সেই মানুষ গুলোকে, সেই দিন থেকে আর করোও সাথে যোগাযোগ রাখিনি , এম,বি, এস পাশ করার পর পুরুলিয়ায় এলাম , উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার নিজের বদলি আটকে থেকেই গেলাম এই গ্রামের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে "
" আর বাড়ি যাওনি কোনদিন"
" বাবা অনেকবার চিঠি দিয়েছিলেন, ফোন করেছিলেন
কিন্তু সব কিছুই হারিয়ে নিজেকে একা করে নিয়েছিলাম,মায়ের কান্নায়, সন্তান হিসাবে দায়িত্ব পালনে বাবার মৃত্যুর পর গিয়েছিলাম শেষ কাজ করতে ,বাবার জমানো টাকা ,বাড়ি,গাড়ি একটি চ্যরিটেবল ট্রাস্টকে দান করে দিয়েছি, পরে মাকে নিয়ে ছিলাম পুরুলিয়ায়, মা ও গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে । "
" তোমার বাবার কোন দোষ ছিল না সুবর্ণ ,প্রোফেসার বাবা-মা র একমাত্র সন্তান তুমি , তার পর তোমরা ব্রাহ্মণ,
আর আমি ! আদিবাসী গরীব বাবার মেয়ে , কাস্ট, জাতি ভিন্ন, তোমরা সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষ ,কিভাবে মেনে নেবেন আমাকে তাদের একমাত্র সন্তানের জন্য। "
" আমিতো সুখী হতে চেয়েছিলাম দেবলীনা , জাতি, ধর্ম কিছুই তো কোনদিন মানিনি , বাবার আভিজাত্য ,অহংকার আমাকে সারাজীবন নিঃসঙ্গ করে দিল । "
" চুপ করো প্লিজ চুপ করো সুবর্ণ , আমি তোমার দুঃখের কারণ হব না বলেই আর যোগাযোগ রাখিনি "
" তুমি সুখী হয়েছ তো ? "
" আমার উপর কম ঝড় যায়নি সুবর্ণ , গ্রামের বাড়ি এসেই বাবা কেমন যেন হয়ে গেলেন সব সময় ভয় , একরাশ আতঙ্ক বাবাকে ঘিরে থাকত
ক্রমশ গ্রাস করছিল মৃত্যুর দিকে , কিছু দিন পর বাবা মারা গেলেন
অসহায় মা আর আমি দিনের পর দিন ভালো করে খেতে পাইনি,
তবু নিজের অদম্য জেদ নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছি
আমাদের খবর পেয়ে বাবার বন্ধু নিজের ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেন।
মা ও মারা গেলেন বিয়ের কিছুদিন পর . নিজের প্রিয়জনদের হারিয়ে,
স্বামীর ঘরে শুরু করলাম নতূন ভাবে জীবন সংগ্রাম ,,
তিনি ও প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়েছেন .. আমার সব কিছু ভুলিয়ে প্রতিটি সাফল্য এনেদিয়েছে তার ভালোবাসায় "
" আজ সব স্মৃতি চোখের পাতায় ভেসে উঠছে দেবলীনা "


 **চলবে...*

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সংখ্যা ১৮ || বর্ষ ৫

ফেরার অধ্যায়: -২য় বর্ষ সংখ্যা ১৫

বিষয় - বই আলোচনা-সংখ্যা ১৬ বর্ষ ২